ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | থেমে নেই মগ সেনাদের নির্যাতন

থেমে নেই মগ সেনাদের নির্যাতন

(ফাইল ছবি)

(ফাইল ছবি)

কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার হত্যা, ধর্ষণ, বসতঘরে অগ্নিসংযোগসহ নানা নির্যাতনের ফলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় উগ্রপন্থী রাখাইনরাও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। নিরুপায় হয়ে প্রতিদিনই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের যত্রতত্র হয়রানি করছে।

যখন তখন কোনো রোহিঙ্গাকে দেখলে আক্রমণ করছে। রোহিঙ্গারা জ্বালানি সংগ্রহ, মাছ শিকার, ক্ষেতখামার করলে তা রাখাইনরা সহ্য করতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের হত্যা করতে এখন আইনগত কোনো বাধা নেই। যারা বাপ-দাদার ভিটাবাড়ি ফেলে আসতে রাজি নয় এমন নিখোঁজ তিন রোহিঙ্গা কিশোরের মধ্যে দুই কিশোরের হাতবাঁধা গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় রাখাইন গোষ্ঠীর উগ্রবাদীরা তাদের হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে রোহিঙ্গারা। গত রোববার স্থানীয়রা লাশ দুইটি খালের কিনারা থেকে উদ্ধার করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহখানেক আগে মংডুর সিকদার পাড়া ও কাইন্দাপাড়াসংলগ্ন ছনবন্যা এলাকার তিন কিশোর পাহাড়ে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করেও তাদের সন্ধান পায়নি পরিবারের সদস্যরা। গত রোববার স্থানীয় কিছু ব্যক্তি নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুইটি লাশ দেখতে পেয়ে গ্রামে খবর দেয়।

তারা আরো জানিয়েছে, মৃৃতদেহ দু’টো একই রশিতে পিছমোড়া হাত বাঁধা ছিল। গায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, হাত বাঁধার পর গলা কেটে তাদের হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা এসে লাশ দুইটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তবে তৃতীয় কিশোরের কোনো সন্ধান এখনো পায়নি এলাকাবাসী। অপর দিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, যারা বাপ দাদার ভিটেমাটি ছাড়তে রাজি নয়, মিয়ানমারে অবস্থানরত বাকি রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে পাঠাতে প্রতি রাতেই সীমান্ত এলাকায় উসকানিমূলক গুলিবর্ষণ করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গুলি বর্ষণের পরের দিন সকালেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রোহিঙ্গারা চলে আসছে বাংলাদেশে। গেল আড়াই মাসে বড় ধরনের সব অনুপ্রবেশের আগের রাতেই ঘটছে গুলিবর্ষণের ঘটনা। সে সাথে মিয়ানমার বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদের নামে রোহিঙ্গা তরুণদের ডেকে নিয়ে গুম করছে বলে অভিযোগ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের। তাদের দাবি প্রতি রাতেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। রাত যত গভীর হয়, গুলির শব্দ ততই বাড়তে থাকে। গত কয়েক দিনেই উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত দিয়েই বড় চারটি অনুপ্রবেশের ঘটনায় ২৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। মিয়ানমারে অবস্থানরত বাকি রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে পাঠাতে মিয়ানমার বাহিনী এ গুলিবর্ষণের কৌশল নিয়েছে বলে মনে করছেন ৩৪ বিজিবি ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর ইকবাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বড় একটা অংশ বাংলাদেশে আসার পর তারা কৌশল গ্রহণ করছে যাতে তারা আর ফেরত না যায়। বর্ডারে তারা প্রতিদিন টহল দিচ্ছে।’ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, গত কয়েক দিন ধরে মিয়ানমার বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদের নামে রোহিঙ্গা তরুণদের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরে সেই তরুণদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। এর আগে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অন্তত ১৫ বার বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘন করেছিল। আর মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এসব রোহিঙ্গাকে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হচ্ছে। নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার নির্ধারিত জমিতে আবাসন তৈরি করে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। রেহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খ্যলা রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশান কাজ করে যাচ্ছে। ত্রাণ বিতরণসহ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে না পারে সে লক্ষ্যে ১২টি চেকপোস্ট রয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার নাগরিকদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাতটি ক্যাম্পের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কাজ এগিয়ে চলছে। সাতটি কেন্দ্রে এ পর্যন্ত বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ছয় লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে। ১২টি অস্থায়ী কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এসব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য উখিয়া ও টেকনাফে ৪১টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। এসব রোহিঙ্গাকে পরিবার পরিকল্পনা সেবাও প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এক লাখ ২৯ হাজার ৭৫০ জনকে হাম রুবেলার টিকা, দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৬৮ জনকে ওপিভি টিকা, এক লাখ ২৭ হাজার ৮১৬ জনকে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল, আট লাখ ৮৩ হাজার ১১৫ জনকে কলেরার টিকা প্রদান করা হয়েছে। কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) রিপোর্ট মতে ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৩১ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় এ সংখ্যা বাড়ছে। এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইডসের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসার পর থেকে কক্সবাজারে মরণব্যাধি এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে ৭৮ রোহিঙ্গা শরণার্থীর শরীরে শনাক্ত হয়েছে এইচআইভি। চিকিৎসকেরা বলছেন, রোহিঙ্গা আগমনের হার অনুযায়ী এ সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এইড্স আক্রান্তদের মধ্যে মহিলা ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার মহিলারাই এইড্স রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও রাখাইন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর মধ্যে এইচআইভি এইডসসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। এদের মধ্যে এইডসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!