নিউজ ডেক্স : রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেওয়ার ঘটনায় গ্রেফতার নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল ও অস্থায়ী কর্মচারী মোস্তফা ফারুক ভয়ঙ্কর সব তথ্য দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশন ও খোদ নির্বাচন কমিশনের তদন্তেও ওঠে এসেছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতিতে কমিশনের ২০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা। এই ২০ জনের মধ্যে জড়িত আছেন অন্তত দুইজন উপজেলা নির্বাচন অফিসার ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) উইংয়ের তিনজন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে লাকি আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারীর কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়ার ঘটনায় চলতি মাসের ১১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার থেকে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। টানা পাঁচ দিনের সেই অভিযানে রোহিঙ্গা দালালসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন (৩৫), তার সহযোগী বিজয় দাস (২৬)ও তার বোন সুমাইয়া (২৪) ওরফে সীমা দাসকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে সুমাইয়ার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় নির্বাচন কমিশনের একটি খোঁয়া যাওয়া ল্যাপটপ (আইপি নম্বর ৪৩৯১)।
পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জড়িত নির্বাচন কমিশনের উচ্চমান সহকারী আবুল খায়ের, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের মোজাম্মেল, মিরসরাই নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার, পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের হোসাইন পাটোয়ারি ও বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ মোস্তফা ফারুকের নাম প্রকাশ করে।
জয়নালের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের কর্মচারী মোস্তফা ফারুক (৩৫)-কে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। মোস্তফা ফারুক চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীন হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বৃহস্পতিবার রাতেই ফারুকের হামজারবাগের বাসায় অভিযান চালিয়ে নির্বাচন কমিশনের দুটি ল্যাপটপ, রেজিস্টার্ড একটি মডেম, তিনটি সিগনেচার প্যাড ও জাতীয় পরিচয়পত্র লেমেনিটিং মেশিন জব্দ করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এর মধ্যে ডেল মডেলের একটি ল্যাপটপ নির্বাচন কমিশনের রেজিস্টার্ড ল্যাপটপ বলে শনাক্ত করে নির্বাচন কমিশনের টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট।
এনআইডি জালিয়াতিতে ইসির ২০ জন : রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেওয়ার মামলায় দায় স্বীকার করে গতকাল শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন। জবানবন্দিতে জয়নাল এই জালিয়াতির সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিসের বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম প্রকাশ করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী সংস্থার এক কর্মকর্তা।
এদিকে গত শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু ছালেহ মোহাম্মদ নোমানের আদালত রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার মামলায় গ্রেফতার নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী মোস্তফা ফারুকের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতের অনুমতি পেয়েই মোস্তফা ফারুকে নিজেদের হেফাজতে নেয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
এ বিষয়ে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, জয়নাল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অনেক তথ্য দিয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এসব তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। আমরা জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকার তথ্য পেয়ে বেশ কয়েকজনের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছি। এ ছাড়া রিমান্ডে থাকা মোস্তফাও বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে, প্রকাশ করেছে জড়িত ব্যক্তির তথ্য।
জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, প্রতিদিন কাজের পরে কর্মকর্তাদের অগোচরে তাদের ল্যাপটপ ব্যবহার করে অথবা তার কাছে থাকা চুরি যাওয়া ল্যাপটপ দিয়ে এনআইডি সার্ভারে রোহিঙ্গাদের ডাটা ইনপুটের কাজ করতো।
জালিয়াতিতে জড়িত উপজেলা নির্বাচন অফিসার : নির্বাচন কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেওয়ায় জড়িত চক্রে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্তত দুই উপজেলা নির্বাচন অফিসার সরাসরি জড়িত আছেন। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে এনআইডি উইংয়ের তিনজন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট।
ইসি সার্ভারে রোহিঙ্গাদের ডাটা ইনপুট হতো রাতে : গ্রেফতারের পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানিয়েছিলেন, অফিস সহকারী হলেও ২০১৮ সাল থেকে নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্সধারী ল্যাপটপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ শুরু করেন তিনি।
জয়নাল বাসায় বসে থানা নির্বাচন অফিসের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির প্রাথমিক কাজ করতেন। নির্বাচন কমিশন থেকে চাকরিচ্যুত টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাগর এনআইডি সার্ভারে তথ্য আপলোড করতেন। তার কাছে ইসি সার্ভারের দেশের সব উপজেলার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড জানা থাকার সুবাদে সে নির্বাচন কমিশনের সেন্ট্রাল সার্ভারে ডাটা ইনপুট দিতো। একই কায়দায় জয়নালের সরবরাহ করা তথ্যে নির্বাচন কমিশনের সেন্ট্রাল সার্ভারে প্রবেশ করে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করতেন সত্যসুন্দর। যিনি রাজধানীর লালাবাগে নির্বাচন কমিশনের সহযোগী প্রযুক্তিবিদ হিসেবে কর্মরত।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, দালালের মাধ্যমে আসা রোহিঙ্গাদের ছবি, আঙুলের ছাপসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন সরবরাহ করতেন। এক্ষেত্রে তিনি ছুটির দিনে অফিস থেকে নিয়ে আসা ওয়েবক্যাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার যন্ত্র, স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড বাসায় ব্যবহার করতেন। জয়নালের সাব-এরিয়া এলাকায় জয়নালের বাসা ছিল ‘মিনি সার্ভার স্টেশন’।
এদিকে গ্রেফতার আরেক অস্থায়ী কর্মচারী মোস্তফা ফারুক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে স্বীকার করেছেন, নির্বাচন কমিশনের চুরি যাওয়া ল্যাপটপ ও রেজিস্টার্ড মডেম ব্যবহার করে এনআইডি সার্ভারে ডাটা ইনপুটি দিতেন তিনি। গত দুই বছরে অন্তত হাজার খানেক রোহিঙ্গা এনআইডি তার হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে। এমনকি জালিয়াতি করে নিজের নামেও জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে মোস্তফা ফারুক।
নির্বাচন কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন জানান, জয়নাল বা মোস্তাফা ফারুক যারাই রোহিঙ্গাদের ডাটা নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে ইনপুট দিয়েছে, তারা সবাই এ জন্য রাতকে বেছে নিয়েছিল। কর্মকর্তাদের চোখ এড়াতে প্রতিদিন রাত ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে এসব তথ্য আপডেট করতো।
তিনি আরো জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসির নিজস্ব মডেম রয়েছে ২০টি। এর মধ্যে একটি পাওয়া গেছে নির্বাচান কমিশনের অস্থায়ী কর্মী মোস্তফা ফারুকের কাছে। রোহিঙ্গা ডাটা ইনপুটের ক্ষেত্রে এই মডেমটি ব্যবহার করা হয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
এদিকে এনআইডি জালিয়াতিতে নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলার পর নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম জাগো নিউজকে বলেছেন, এই জালিয়াতিতে যে পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ফৌজদারি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
তিনধাপে এনআইডির জন্য চট্টগ্রাম আসে রোহিঙ্গারা : তদন্তকারী সংস্থা, দুদক ও নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে একেবারে শুরুর কাজটা করে রোহিঙ্গা দালালরাই। তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরিতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের খুঁজে বের করে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এনআইডি তৈরিতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার শহরে নিয়ে যায়। পরে আরেকটি দালাল চক্র তাদের নিয়ে আসে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে পৌঁছাতেই আরেক দালালের হাতে বদল হয় রোহিঙ্গারা। সেই দালাল তাদের নিয়ে আসতো নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল ও অস্থায়ী কর্মী মোস্তফা ফারুকদের কাছে। পরে তাদের বাসাতেই নির্বাচন কমিশনের চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্ক্যানার, মডেম, ক্যামেরা ও সিগনেচার প্যাড ব্যবহার করে তৈরি হতো জাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি); রোহিঙ্গারা হয়ে যেত বাংলাদেশি ভোটার!
সূত্র : জাগো নিউজ