ব্রেকিং নিউজ

ক্ষত

story-mahmud20161220175758

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : ‘তোমার মন চাইলে যে কারো সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে পারো। আমি তাতে রাগ করবো না- বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর এমন কথা শুনে ভড়কে যায় নববধূ সোহানা। ‘এ কেমন মানুষ রে বাবা?’ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে। ‘যতটুকু জেনেছি তাতে সৃজনশীল মানুষ সোহান।’ ভাবতে থাকে সোহানা। তার মানে এমন স্বাধীনতা কোনো নারীই হয়তো চাইবে না।

কৈশোর বা তারুণ্যের প্রথম প্রহরে কমবেশি সবাই একটুআধটু প্রেমে পড়ে। সম্পর্কটা হয়তো শরীর পর্যন্ত গড়ায়। কখনো সেটা পরিণতি পায়, কখনো পায় না। একটা সময় হয়তো নতুন পথের সন্ধান করে। অতীতের স্মৃতি আগলে জীবনকে দুর্বিষহ করার মানে হয় না। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের বেলাতেই তা প্রযোজ্য। তাই বলে কেউ ওপেনে বলবে না যে, আমি অন্য কারো সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে চাই। করলেও নিজের স্বামীকে অন্তত বলবে না। বিষয়টা যেমন গোপন; তার স্বীকারোক্তি কখনোই প্রকাশ্য হওয়ার মতো নয়।

বিয়ের প্রস্তাব আসার পর নামের মিল দেখে পুলকিত হয়েছিল সোহানা। আবিদ রহমান সোহান একজন সৃজনশীল মানুষ। সানজিদা ইসলাম সোহানা সবে স্নাতক শেষ করেছে। সেই তো অনেক সময়। মেয়ে বিবাহের যোগ্য হয়েছে অনেক আগেই। এতো দিন রাজি না হলেও এবার অমত করেনি।

স্কুলজীবন থেকেই দুর্সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে প্রেম ছিলো সোহানার। বছর তিনেক ভালোই ছিলো সম্পর্কটা। কোনো কিছুই আড়ালে ছিলো না। মানসিক বা শারীরিক সম্মতিরও ঘাটতি ছিলো না। কিন্তু প্রেমিকের মামাতো বোনের সঙ্গে একই বিছানায় আবিষ্কার করার পর চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এসেছিলো সোহানা।

তারপর এ পর্যন্ত আর কোনো সম্পর্কে নিজেকে আবদ্ধ করেনি। মাঝে মাঝে পছন্দের কারো সঙ্গে শরীরী উৎসব পালন করা তার কাছে মামুলিই মনে হয়েছে। এতটুকুও পাপবোধ বা অনুশোচনা হয়নি তার। সে শরীরের প্রয়োজনে হোক কিংবা ক্ষোভ-অভিমানে হোক। নিজের চাহিদাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। তাই বলে কি বিয়ের প্রথম রাতে সেসব কথা স্বামীর কাছে স্বীকার করা যায়? বা বলা যায়, ‘আমার ওই ছেলের সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে ইচ্ছা করে?’ কেউ কি বলেছে আজ পর্যন্ত?

সোহান-সোহানার বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। অনুষ্ঠানের আগে কিছুদিন দু’জনের ফোনে কথা হয়েছে। সোহানকে উচ্ছ্বল এবং হাস্যোজ্জ্বল একটা মানুষ মনে হয়েছে সোহানার। এছাড়া সুদর্শন তো বটেই। শরীর-শরীর খেলা অনেক তো হলো। বয়সও বাড়ছে সোহানার। উড়ে উড়ে আর কত দূর যাওয়া যায়? একটু আশ্রয় বা বিশ্রাম তো দরকার। তাই তো একবাক্যে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতেই এমন কথা সোহানা কীভাবে নিচ্ছে সেটা কি ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি সোহান।

– কি হলো, কিছু বলছো না যে।
– কি বলবো? আপনি যা বলার বলুন।
– বয়স তো কম হলো না। অনার্স শেষ করলে। যৌবনের চাহিদা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তুমিও হয়তো করোনি। পুরনো কেউ থাকলে বলতে পারো। একদিনেই তো আর ফিরে আসতে পারবে না। সময় নিতে হবে।
– কি বললে আপনি খুশি হবেন বুঝতে পারছি না। সত্যি বলবো নাকি আড়াল করবো। এমন পরিস্থিতি কোনো মেয়ে সহজভাবে নিতে পারে কিনা আমার জানা নেই? আমি কি আপনাকে অসুস্থ ভাবতে পারি? নাকি নিজে অসুস্থ হয়ে উঠবো আপনার মতো?
– কেন? অসুস্থ ভাবার কিছু নেই। আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই কথাগুলো তোমাকে বলছি। ব্যাপারটি পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক। রেগে গেলে সমাধান হওয়ার নয়। কারণ এটা একটা ভয়ানক ব্যাধি। দেখো না, ছয় বছরের একটি কন্যাশিশু উপযুক্ত নয় জেনেও ধর্ষক সাইফুল ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গ কেটে ধর্ষণ করেছে। আসলে চরিত্র আমাদের মুকুট নয় বরং মুখোশ।
– তবে আমার কথাগুলো শোনার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিন। শোনার পরে একই বিছানায় আমার সঙ্গে শোবেন কিনা ভেবে নিন। নাকি উচ্ছিষ্ট ভেবে ভাগাড়ে ফেলে দেবেন?
– ঠিক আছে বলো। শুনতে সমস্যা কোথায়? সিদ্ধান্ত না হয় পরেও নেয়া যাবে।

সোহানের সম্মতিসূচক কথা শুনে এক মুহূর্তে থমকে যায় সোহানা। সোহানা হয়তো ভেবেছিলো সোহান তাকে থামিয়ে দেবে। বলবে, অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে যাও। আসো আমরা নতুন করে নতুন জীবন শুরু করি। না, তা তো নয়। এখন কী বলবে বুঝতে পারছে না সোহানা। কীভাবে শুরু করবে? সব সময় জেনে এসেছে বাসর রাত খুব মধুর হয়। আর এ কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি সে। ব্যক্তিগত গোপন বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রী হয়তো খোলামেলা কথা বলবে- এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এমন উদারতা কোন স্ত্রী কামনা করে? বিশেষ করে আমাদের এই বাংলাদেশে। যেখানে যৌনতা এখনো পাপ, গর্হিত অপরাধ।

– শুনুন, প্রত্যেকটি মেয়েই তার সতীত্বকে আগলে রাখতে চায়। অযথা সতীত্বকে বিসর্জন দেয় না। আপনারা পুরুষ যারা; নারীর মাঝে শুধু সতীত্ব খোঁজেন। নিজের সততা সম্পর্কে থাকেন পুরাই উদাসীন। কারণ আপনাদের তো সতীচ্ছদ নেই। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনি এ পর্যন্ত কয়টা মেয়ের সতীত্ব নষ্ট করেছেন?
– এখানে সতীত্বের প্রসঙ্গ আসছে কেন? সতীত্ব বলতে কিছু নেই। পাতলা একটি আবরণ নারীর সততা নির্ণয়ে যথেষ্ট নয়। আমার কথা বলার মূল প্রসঙ্গটি তুমি বোধ হয় ভালোভাবে নাওনি।
– তাহলে কী বলতে চাইছেন আপনি? মন চাইলে যে কারো সঙ্গে ‘যা খুশি’ করতে পারবো। আপনি তাতে রাগ করবেন না। আমি কি এমন অনুমতি চেয়েছি কখনো? তাহলে আপনাকে বিয়ে করলাম কেন? আর প্রয়োজন হলে কি আপনার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করবো? কেউ করেছে কখনো?
– আহা! উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আমি বলতে চাচ্ছি, আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ‘যা খুশি’ বা চরিত্র নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কখনো যদি মনে করো, কারো সঙ্গে ব্যাপারটা তোমার জন্য জরুরি। তাহলে সেটা করতে পারো। আমি তা-ই বলতে চেয়েছি।
– এসবের মানে কি? কেউ মানে কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে এমন কথা বলে? তাও আবার নববিবাহিত দম্পতি।
– না, হয়তো কেউ বলে না। তবে আমি বললাম। যেহেতু আমি ভুক্তভোগি। আমি দেখে শিখেছি। কারণ এটা এমন একটা বিষয়- যা বিধি-নিষেধ মানে না। ইচ্ছা হলে সব বাঁধা পেরিয়ে সে তার অভিপ্রায় চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
– তা-ই বলে, আজ রাতেই এমন কথা বলার দরকার ছিলো? প্রথম রাতটি সবাই কতো মধুর করে ভাবে।
– আমি জানতাম তুমি অবাক হবে। আসলে আমার কাছে মধুর রাত বলে কিছু নেই। এমনটা আমি অনেক আগেই হিসেব করে রেখেছিলাম। দেখ, আমরা মুখোশ পরে আছি। আমি বাইরে গিয়ে হাজারটা মেয়ের সাথে ঢলাঢলি করে ফিরি। বাসায় এসে বউয়ের অন্তর্বাস পরীক্ষা করে দেখি, সেখানে কারো বীর্য লেগে আছে কিনা।

সোহানা এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ‘আপনার মুখে মধুর কোনো আলাপ নেই? সেই শুরু থেকে সেক্স সেক্স আর সেক্স নিয়েই আছেন। এর বাইরে কিছুই ভাবতে পারেন না?’
সোহানার কথা শুনে সোহান চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে তাকায় সোহানার দিকে। সোহানের দু’চোখে টলটল করছে অশ্রু।
– একি আপনি কাঁদছেন কেন?
– তোমার কাছে আর লুকাবো না।
– কী হয়েছে বলুন আমাকে।
– আমি একজনকে ভালোবাসতাম। সাত বছর ছিলো সে সম্পর্ক। সাত বছরই আমাদের সম্পর্ক শরীরকেন্দ্রিক ছিলো। প্রত্যেকবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা একই কক্ষে ছিলাম। কিন্তু মাঝখানে বছর দুই আমাদের যোগাযোগে শৈথিল্য দেখা দেয়। আমি ঠিক কিছু করতে পারছিলাম না। সেই থেকে শুরু হয় মানসিক দ্বন্দ্ব। এরই মধ্যে আমি তার প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি। কারণ সে অন্যের বিছানায় যেতে ‘নাকি’ বাধ্য হয়েছিলো। তার আকাঙ্ক্ষাটা তখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। অবশেষে আমিই তাকে মুক্তি দিয়েছি। যেহেতু আমার উপর তার আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে বুঝেছি- ভালোবাসা, দাম্পত্য বা সংসার কোনো কিছুই মুখ্য নয়। সবকিছুর মূলে ওই একটা বিষয়।

সোহানের কথাগুলো শুনে এবার সোহানার চোখে জল। যেন কিছু বলার ভাষা নেই তার। নিজের বুকে পাহাড় সমান দুঃখ চেপে আরেক দুঃখের পাহাড়ে মুখ গুজলো সে। নিজের দুঃখের কথা আর বলাই হয় না। মনে মনে ভাবে, এই বুঝি জীবন? জগতের ভালোবাসা। মানুষের প্রাপ্তি। এমন ক্ষত নিয়েও হাসিমুখে বেঁচে থাকার অভিনয় করে যায় সবাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!