ফারুক মাহমুদ : বয়স যখন ছয় বাবা আচানক স্ট্রোক করে মারা গেল। সৌদি ফেরত বাবার শূন্যতা অতটুকুন বয়সেই বুঝতে হলো তাকে। চেনা পরিবেশ পাল্টে গেল, আত্মীয়রাও সরে গেলো যে যার মতো। বাবার বাড়ি ছেড়ে ঠাঁই হলো নানাবাড়িতে। ক্লাস থ্রি’তে যখন উঠল, প্রিয় প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমও বদলি হয়ে চলে গেলেন অন্য স্কুলে। নিয়তি সবাইকে তার থেকে দূরে ঠেলে দিলেও, মুসতারিন আঁটুলির মতো আঁকড়ে ধরে ছিলো পড়ালেখাকে।
গত ২২ ডিসেম্বর লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসনের নিবিড় তত্ত্বাবধানে সদ্য জাতীয়করণকৃত গোলামবারী সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। জানা যায় উক্ত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রনয়ণ করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই এবং মুসতারিন সেই একশো নাম্বারের ভর্তি পরীক্ষায় আটানব্বই নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। গতকাল ২৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে মুসতারিন আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৬০০ নম্বরে ৫৮০ নম্বর পেয়ে জিপিএ-৫ অর্জন করে।
গতকাল ২৪ ডিসেম্বর বিকেল বেলা মুসতারিনের প্রিয় শিক্ষক রেজাউল করিম মুসতারিনকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। সাথে তার মা শাহীন আক্তারও আসেন। আলাপ করে জানতে পারি তারা তিন ভাই বোন এবং তার বড়বোন ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিবে।
মুসতারিনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সে বড় হয়ে কি হতে চায়? জবাবে সে বলে, আমি রেজাউল স্যারের মতো শিক্ষক হবো। স্যার, যেভাবে আমি এবং আমার বড় বোনকে পড়িয়েছেন; আমিও এভাবে একদিন অনেককে পড়াবো। এক টাকাও নিবো না। স্যার আমাদেরকে সেটা শিখিয়েছেন। এটা আমার স্বপ্ন। মেয়ের কথা শুনে পাশে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মুসতারিনের মা।
মুসতারিনের মা শাহীন আক্তার বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার সবকিছু বদলে গেল। অভাব হয়ে গেলো নিজের ছায়ার মতো নিত্যসঙ্গী। আমার ভাইয়েরা যে সহযোগিতা দেয়, তা দিয়ে নুন আনতে ফুরায়। তিন ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ চালিয়ে পড়ালেখা করানো দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছু না। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে রেজাউল স্যার এবং স্যারের স্ত্রী মোতাহেরা ম্যাডামের জন্য। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুক।
মুসতারিনের প্রিয় শিক্ষক বর্তমানে চুনতি শাহ সুফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রেজাউল করিম বলেন, মুসতারিন ও তার বড় বোনকে আমি একসময় পড়াতাম। তখন তিনহাজার টাকা করে আমাকে দেওয়া হতো। তাদের বাবা মোহাম্মদ ইলিয়াছ মারা যাওয়ার পর মুসতারিন ও তার বোনকে আমার বাসায় এনে পড়াশোনা করালেও আমি একটাকাও নিই নাই বরং আমি এবং আমার শিক্ষক-স্ত্রী মোতাহেরা বেগম সাধ্যমতো তাদেরকে আর্থিক সাহায্য করে যাচ্ছি। দুই এতিম শিশুর পাশে আমি এবং আমার স্ত্রী থাকতে পেরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। মুসতারিনকে উৎসাহিত করার জন্য আপনার কাছে নিয়ে এসেছি, স্যার।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু আসলামের কাছে গোলামবারী সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মুসতারিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষার খাতা মুল্যায়নের সময় একজন পরীক্ষার্থী একশোতে একশো পেয়েছে জেনে খাতাটি আমি রি চেক করি এবং সে আসলেই একশো নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মঅহংকার যেন সৃষ্টি না হয় তাই পরীক্ষা কমিটির সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই নম্বর কেটে তাকে আটানব্বই দেওয়া হয়। চমৎকার তার হাতের লেখা। যথাযথ পরিচর্যা পেলে এই মেয়ে একদিন নাসার বিজ্ঞানী হবে কিংবা অনেক বড় কিছু হবে।
যেহেতু জানতে পেরেছি তার পরিবারের অভাবের কথা, সেহেতু তার মাকে উপজেলা প্রশাসনের গৃহীত প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত করে একটা সেলাই মেশিন ব্যবস্থা করে পাশে থাকার চেষ্টা করবো।
প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের একজন অজ্ঞাতকুলশীল কর্মী হিসেবে কায়োমনোবাক্যে চাই, মুসতারিন আগামী দিনগুলোতে তার মেধার প্রজ্বলিত শিখা দেদীপ্যমান রাখুক অবিরত এবং সত্যিকারের একজন মানবিক প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিমের সহকর্মী হতে পেরে গর্বিত।
লেখক : সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম