Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | দুর্নীতিবাজদের চক্ষুশূল চট্টগ্রামের ডিসি

দুর্নীতিবাজদের চক্ষুশূল চট্টগ্রামের ডিসি

নিউজ ডেক্স : দখলবাজ, ভূমিদস্যু, পাহাড়খেকো ও দুর্নীতিবাজদের কাছে আতঙ্কের নাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান। চট্টগ্রামের এই ডিসির সর্বশেষ প্রচেষ্টায় প্রায় আট হাজার কোটি টাকা মূল্যের খাসজমি উদ্ধারের কার্যক্রম চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার খাসজমি উদ্ধারের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে একের পর এক অভিযান, গ্রেপ্তার, মামলা দায়ের, বদলি, বরখাস্তসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরাগভাজনদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন তিনি। সব উপেক্ষা করে এরই মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা, সার্কেল ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস দালালমুক্ত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই ডিসি।

এ ছাড়া তার নিরলস প্রচেষ্টা ও তৎপরতায় চট্টগ্রামে সমন্বিত সরকারি অফিস, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সরকারি অফিসে সাধারণের সেবা নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া কভিড-১৯সহ সব ধরনের দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার মমিনুর। ছদ্মবেশে বিভিন্ন উপজেলা, সার্কেল ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে আকস্মিক পরিদর্শন করেন। দ্রুত অভিযান চালিয়ে ভূমি অফিসের দালালদের বিরুদ্ধে জেলহাজতসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি। এসব অফিসের ১৮৩ জন উমেদারকে বের করে দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতির দায়ে কয়েকজন ভূমি সহকারী, উপসহকারী কর্মকর্তা ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি অফিসগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম্য রোধ, সার্বিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ অধীনস্থ সব কার্যালয়ে সহস্রাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ডিসি মমিনুর রহমান চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়খেকো, ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যবান খাসজমি উদ্ধার করেছেন। বর্তমানে সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুরের প্রায় আট হাজার কোটি টাকার ৩১০০ একর সরকারি খাসজমি উদ্ধার কার্যক্রম চলছে। চট্টগ্রামের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে এখানে নাইট-সাফারি পার্কসহ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে।

শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরীর পাহাড় থেকে দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছেন তিনি। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ৫৮৭টি অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করেছেন। তাঁর উদ্যোগে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর উত্তর কাট্টলী মৌজার প্রায় ৩০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করে অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানটিকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণের জন্য প্রস্তাব পাঠান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘরের নকশা চূড়ান্ত হয়ে ডিপিপি প্রস্তুতের কাজ চলমান রয়েছে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম থেকে যুক্ত থাকা যাত্রা মোহন সেনের মহামূল্যবান বাড়িটি উদ্ধার ও সংরক্ষণেও ভূমিকা রয়েছে ডিসি মমিনুরের। ভূমিদস্যুরা গত বছরের ৪ জানুয়ারি বাড়িটি ভেঙে দখল করার অপচেষ্টা চালালে জেলা প্রশাসক স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ও সুশীল সমাজের হস্তক্ষেপে ঐতিহাসিক এই বাড়ি দখলমুক্ত করেন। বর্তমানে বাড়িটি সংরক্ষণ করে বিপ্লবী জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কার্যক্রম চলছে।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উপজেলা, জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে সরকারি অফিসের জন্য পরিকল্পিত ও সমন্বিত অফিস ভবন নির্মাণের তাগিদ দিলে শুরুতেই তৎপর হয়ে ওঠেন ডিসি মমিনুর। চট্টগ্রাম জেলার চান্দগাঁও (বন্দর) মৌজায় ৭৩.৪২ একর খাসজমিতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সরকারি অফিসের জন্য বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং সুপরিকল্পিত সমন্বিত সরকারি অফিস কমপ্লেক্স নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। কর্ণফুলী নদীর পাড়ে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে একই স্থানে সরকারি অফিস আধুনিক নগরায়ণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পর্যটনের বিকাশেও ভূমিকা রয়েছে তার। দেশজুড়ে পরিচিত পাওয়া সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে যোগাযোগব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, সেখানে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিচটিকে সংরক্ষিত পর্যটন জোন হিসেবে গেজেটভুক্ত করার উদ্যোগ নেন তিনি।

চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসনের নিজস্ব পরিচালনায় ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য সুষ্ঠু যুগপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের সরাসরি পরিচালনায় একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা মাথায় আসে তার। এরই ফলে কালেক্টরেট স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থী ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হবে। পূর্ব নাছিরাবাদ মৌজায় অবস্থিত একটি এপিএমবি বোর্ড কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভবনে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হবে।

প্রায় এক যুগ ধরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কোনো নতুন নিয়োগ না হওয়ায় কার্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল। তার উদ্যোগে ২১৭ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতে। বর্তমানে আরো ৪৭ জন নতুন কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। শুধু তা-ই নয়, নবনিযুক্ত কর্মচারীদের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন তিনি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সর্বস্তরের সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের দৃষ্টান্তও রয়েছে তার। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার জন্য গাড়ি ক্রয় এবং নতুন প্রাণী সংগ্রহের জন্য দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করেন।

কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধ, ভেজালবিরোধী অভিযান ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মহানগর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। ৩০০ জন ভলান্টিয়ারকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে। এরা করোনাকালীন দুর্যোগে জেলা প্রশাসন কর্তৃক সহায়তা কার্যক্রমে নিরলসভাবে কাজ করেছে এবং বর্তমানেও সমাজের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে জেলা প্রশাসনকে সহায়তা করছে।

মানবিক কর্মকাণ্ডেও এগিয়ে রয়েছেন তিনি। চলতি বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহত পরিবারগুলোর পাশে ছিলেন জেলা প্রশাসক। এ দুর্ঘটনায় নিহত ৫১ জন, ৯৯ জন গুরুতর আহতসহ প্রত্যেক হতাহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করে জেলা প্রশাসন। পাহাড় ধসের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তর ও সার্বিক ব্যবস্থপনার জন্যও জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

তার নির্দেশে জেলা প্রশাসনের ৫০ জন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের অধীনে ৫০ জনসহ মোট ৮০০ জনের ‘এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন অ্যান্ড ডিজাস্টার রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে। এ টিমের সদস্যদের বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।

এদিকে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেও সজাগ দৃষ্টি ডিসি মমিনুরের। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর ঘিরে হাটহাজারীতে হেফাজতের তাণ্ডব দমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। সেদিন বিক্ষুব্ধরা থানা ও ভূমি অফিস ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে। জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয়ে বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যে সমন্বয় করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট, পরিবহন ধর্মঘট, ট্যাংক লরি-প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘট, প্রতিটি শ্রমিক অসন্তোষ সাফল্যের সঙ্গে নিষ্পত্তি ও সমাধান করেছেন। চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করেছেন। চট্টগ্রামে হার্ট-ফাউন্ডেশন হাসপাতাল চালুকরণে সহায়তা করেছেন তিনি।

এ ছাড়া  নতুন বালুমহাল ঘোষণা করে অবৈধ বালু ও মাটি কাটা বন্ধ করা, হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ, ডলু আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্কুল, মসজিদ, মন্দির, কমিউনিটি সেন্টার এবং পুকুর নির্মাণ, পতেঙ্গা সি বিচ, আনোয়ারা সি বিচ, গুলিয়াখালী সি বিচকে বিচ ম্যানেজমন্ট কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধান করা, নতুন শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ, হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়ের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় আমার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নানা ষড়যন্ত্র চলছিল। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলকালীন  অসত্য সংবাদ কিছু কিছু মিডিয়ায় প্রকাশ করা হচ্ছে। এসংক্রান্ত একটি লিগ্যাল নোটিশ ইস্যু হওয়ার আগেই বা নোটিশ গ্রহীতারা নোটিশ পাওয়ার আগেই কিছু মিডিয়ায় লিগ্যাল নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয়, বিষয়টি সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত একটি অপপ্রচার।’ -কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!