ফারুক মাহমুদ : আমি ভয় পেতে ভালোবাসি, তাই বারবার চাম্বিতে ফিরে আসি। চাম্বি খালের লাগোয়া হাতির প্রজনন কেন্দ্রে যাওয়া হলো কিংবদন্তী শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর গান, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’ একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে গাওয়ার মতো।
এইতো ক’দিন আগেও চৌদ্দ পনেরোটা হাতির পাল লোহাগাড়ার একদম সদর ইউনিয়নে চলে এসেছিলো। গত সপ্তাহে লোকালয়ে আসা হাতির আক্রমণে বোয়ালখালীতে তিনজন মারা গেছে। ক্ষেতে ধান পাকলে এবং পাহাড়ে কলাগাছ কিংবা বাঁশকরোলের সংকট দেখা দিলে হাতিরা নাকি লোকালয়ে চলে আসে। হাতি বিষয়ে অভিজ্ঞরা তেমনই বলেন।
চুনতি অভয়ারণ্য হলো হাতিদের চলাচলের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল। সারা বছর অভয়ারণ্যে ঘুরফিরবে আর প্রজননের সময় হাতিরা চলে আসবে চাম্বি খালের উজানে থাকা হিমছড়ি নামক স্থানে। আমাদের গাইড শামছুল আলম বলেন, চুনতি অভয়ারণ্যের কোথাও হাতি না থাকলেও হিমছড়িতে অবশ্যই হাতি থাকবে।
শামছুল আলম সেই ভয়ংকর হিমছড়িতে গত ত্রিশ বছর ধরে হাতির সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বড় ধরনের কোন বিপদ ছাড়াই পানের বরজ করে আসছেন। এখনও প্রতিদিন সকাল হলে ভাতের মোছা নিয়ে তিনি হিমছড়িতে তাঁর পান বরজে চলে যান।
কিছুদিন আগে চাম্বি পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সাথে দেখা হলে এডভেঞ্চার করার জন্য হাতির রাজ্য চাম্বির উৎপত্তি মুখে যাওয়ার প্রস্তাব দেই। আমি প্রস্তাব দিতে না দিতেই তিনি নাকচ করে দেন। বর্তমানে হাতি পাগলা হয়ে যাওয়ার কথা বলেন, প্রতি রাতে চাম্বি লেকের আশেপাশে হাতি আসার কথা বলেন। হাতি-ভীতি দেখিয়ে আমাকে নিরুৎসাহিত করলেও আমি থমকে যাওয়ার লোক ছিলাম না। অগত্যা তিনি রাজি হলেন এবং সেই দিনের আলোকে গতকাল শুক্রবার সকাল নয়টায় চাম্বি লেকের ঘাটে পৌঁছে যাই।
কয়েকটা দা, লাঠিসোটা এবং অন্যান্য আপদকালীন জিনিসপত্র নিয়ে ঠিক দশটায় ঘাটলা থেকে আমরা স্পিডবোটে রওয়ানা দেই। বলে রাখা ভালো, আমাদের এইবারের গ্রুপটা নানা বয়সের এবং বিবিধ পেশার লোকজন নিয়ে গঠিত ছিলো। প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, বন বিট কর্মকর্তা ছিলেন, চাম্বি পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি- সহ-সভাপতি সহ স্থানীয় লোকজন ছিলেন। আর বিশাল দা নিয়ে আমাদের গাইড শামছুদা তো ছিলেনই। স্পিড বোট আগাতে থাকে, চাম্বিও পেঁয়াজের খোসার মতো তার সৌন্দর্যের খোসা ছড়াতে থাকে। সচরাচর স্পিডবোট যতটুকু যায় সেই জায়গার পর থেকেই চাম্বির সৌন্দর্যের খেলা শুরু হয়। রাবার ড্যামের জন্য নতুন করে পানি জমানো হয়েছে, তাই ছড়ার আশেপাশে থাকা গাছগুলো পানির নিচে ডুবে গেছে। চাম্বির লেকের উজানে এরকম ডুবন্ত গাছ দেখে এক ভ্রমণসঙ্গী তো বলেই ফেললেন, গরীবের রাতারগুল।
স্পিডবোট নির্দিষ্ট এক জায়গায় থামে আর ভয়ের রাজত্ব শুরু হয় ঠিক সেখান থেকেই। আমাদের গাইড শামছুদা এবার সবাইকে ডেকে নিয়ে ব্রিফ করলেন। তিনি বললেন, হাতি সবসময় সামনে দেখতে পায়। আচানক হাতির মুখোমুখি হলে আঁকাবাঁকা করে দৌড়াবেন। অথবা সবাই মিলে জোরে জোরে তালি বাজাবেন তাহলে হাতি আর আগাবে না। দা, লাঠি সহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তো আছেই। সামছুদা অবলীলায় বলে যাচ্ছেন আর আমরা সবাই অগ্রহায়ণেও ঘেমেই চলছিলাম।
আমাদের ভ্রমণসঙ্গী মৌলভী আকবর এবার মোনাজাত ধরলেন। আমরা সবাই মোনাজাতে শামিল হলাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। গাইডকে সামনে এবং বিট অফিসারকে পেছনে দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। সারা পথ জুড়ে হাতির তাজা মল। ভয় পাই, ঘাবড়ে যাই। হাঁটার গতি মন্থর হয়ে আসে। তারপরও এগিয়ে যাই। আচানক বালির উপর হাতির বড় বড় পায়ের চিহ্ন দেখি। অভিজ্ঞ শামছুদা বলেন, সিঙ্গেল হাতিটা হবে নিশ্চিত। আকারে অনেক বড় হাতিটা। শুনে আমরা ঘাবড়ে যাই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে যাওয়ার তাগাদা দেয়। দেখেই ফিরবো এমন মনোবলের কারণে আমাদের ফেরা হয় না। দীর্ঘ দেড় ঘন্টা হেঁটে, সারা পথ একটা হাতি হাতি ভয় সঙ্গী করে এবং জোঁকের কামড় সহ্য করে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই।
প্রথমে পড়ে চাম্বি গুহা। আঁকাবাকা ঝিরি পেরিয়ে দেখা মিলে এই গুহার। গুহায় আদি মানব কিংবা মাকড়সার মতো ইতলবিতল করে কিছুক্ষণ হেঁটে গেলে দেখা মিলে চাম্বি ঝর্ণার। স্বীকার করতে দ্বিধা নাই, এই ঝর্ণা দামতুয়া কিংবা খৈয়াছড়ার মতো বিশাল না, কিন্তু প্রচুর ভয় এবং কষ্ট আছে। যারা ভয় এবং কষ্ট পেতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই ঝর্ণা।
কিভাবে যাবেন : লোহাগাড়া দরবেশহাট থেকে এমচরহাট হয়ে চাম্বি খাল কিংবা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ের লোহাগাড়া অংশের শাহ সাহেব গেইট থেকে ইসহাক মিয়া সড়ক হয়ে চাম্বি খাল যেতে হবে। সেখান থেকে স্পিডবোটে বিশ মিনিট যেতে হবে এবং অবশ্যই গাইড নিয়ে যেতে হবে। যারা এডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের জন্য এই ট্রেকিং নয়, যারা ম্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন শুধু তাদের জন্য এই ট্রেকিং।