- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

লেখার জগতে আসার আদি অন্ত

ফিরোজা সামাদ : জন্ম আমার সেই পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে সর্ব দক্ষিণের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজপাড়াগাঁয়ে। আমার মা ছিলেন একজন বিদুষী জ্ঞানী নারী। মা আমার বেশ ভালোই লেখাপড়া জানতেন। রাতে মায়ের পাশে শুয়ে অনেক ছড়া,কবিতা ও গল্প শুনে শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম!

বড়োদের মুখে শুনেছি, সেই ছোট্টবেলা থেকেই নাকি আধো আধো ও তোতলামি কথায় মুখে মুখে ছড়া কাটতাম বলে অামায় নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। কখনো আবার ছড়া পড়া শেষ করে নিজেই নিজের মাথায় হাত বুলাতাম আর বলতাম সুন্নর ! সুন্নর ! একা একাই হাতে তালি বাজাতাম! এজন্য বোকামির খাতায় আমার নামটি জ্বলজ্বল করতো। সমবয়সী যারা সবাই জোট বেঁধে আমায় ঠকানোর চেষ্টা করতো। আসলে তা ঠকানো বললে ভুল হবে। আমার বোকামি দেখে তারা মজা পেতো। সেই সমবয়সীরাই এখন আমার অতীতের বাল্যবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে চোখের পানি ঝরায় আর তাতে আমি ভীষণ আনন্দিত হই এই ভেবে যে, ভাগ্যিস আমি অত্যন্ত সহজ সরল ও বোকা ছিলাম! নাহলে এই কাহিনি কোনোদিনও জানা হতো না! আমার ছোটবেলা নিয়ে কেউ কোনো গল্পও করতো না। পরম্পরাও ছোট্ট সেই আমার মানবিক আচরণ, সারল্যতার প্রতিদানের কথা কোনোদিনও জানতে পারতো না! আমি মহান অাল্লাহ্ সুবহানাহু তাআ’লার কাছে জানাই শোকর আলহামদুলিল্লাহ্!

আমার নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে এতিমের খাতায় নাম লিপিবদ্ধ করলেন মহান অাল্লাহ্ । আমার মায়ের বয়স তখন মাত্র বত্রিশ বা তেত্রিশ বছর। আমার মায়ের ব্যক্তিত্ব তখন দারুণ পরিপক্ব। সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, মানবিক শিক্ষা ও আচরণকে অবলম্বন করে সাত মাসের গর্ভাবস্থায় আমাদের তিন তিনটি বোনের লেখাপড়া সহ সামাজিক জীবন যাপনের দায়ভার কাঁধে তুলে নিলেন অসীম সাহসের ডানায় ভর করে। সেই দুঃসময়ে আমার মামারা ( মা’য়ের আপন ভাই ) । আমার মা’য়ের ভরসার জায়গা করে দিয়ে বোনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেই সমীকরণ এই যুগে এসে কোথাও দেখা যাবেনা।

আমার দাদাও ধনাঢ্য ও বিশাল জমির একচ্ছত্র মালিক ছিলেন। তার পাঁচটি ছেলেকেই তিনি পিটি, জিটি পাশ করিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম দুই ছেলে ছিলো আদরের নন্দদুলাল। তারা কোনো কাজকর্ম করতেন না। ধুতি-পাঞ্জাবী,চটি ও সৌখিন লাঠি হাতে নিয়ে চষে বেড়াতেন। পরের দুই ছেলে দলিল লেখকের খাতায় নাম লেখালেন। অবশ্য তখন এই পেশাটিকে অভিজাত হিসেবে গন্য করা হতো। বিশাল জমির মালিকানার পর এই দলিল লেখার পেশাটি অন্য একটি স্ট্যাটাস হিসেবে নিয়েছিলেন তারা। আমার আব্বা আর একটু অগ্রসর হয়ে পটুয়াখালী থেকে স্ট্যাম্প ভেন্ডারির এক লাইসেন্স এবং সাথে দলিল লেখকেরও লাইসেন্স করে বেশ নামকরা ভেন্ডার ও মোক্তার বনে গেলেন। তখন দলিল লেখকদের পদমর্যাদা ছিলো মোক্তার।

আমার আব্বার মৃত্যু হয়েছিলো দুরারোগ্য ” ক্যান্সারে! সেই ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে গিয়ে আবাদি জমির অনেকটাই বন্ধক দিতে হয়েছিলো। ঢাকার মিটফোর্ড হসপিটালে আব্বার চিকিৎসা চলছিলো সেই ১৯৬৮ ইং সনে।

কিন্তু ; কিছুতেই আব্বা অার ফিরলেন না। চলে গেলেন সাত মাসের গর্ভবতী স্ত্রী ও তিনটি শিশু কন্যাকে অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে। আমরা এতোই অভাগী ছিলাম আব্বার মৃতদেহটিও দেখার ভাগ্য হয়নি। শুনেছি আব্বাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এখনো মাঝে মাঝে যাই কিস্তু আব্বার কবর কোথায় জানিনা। শুধু মাটি ছুঁয়ে মহান অাল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হায় অাল্লাহ্ আমি তো জানিনা কোথায় আব্বার কবর! তুমি আমার আব্বার কবরের জায়গাটুকু সাদাকা হিসেবে কবুল করে নাও।

আজ এই পর্যন্ত আবার দেখা হবে পরবর্তী ২য় পর্বে, ততক্ষণে সবাই সতর্কতার সাথে সুস্থ ও সুরক্ষিত থাকুন!