- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যু : অবহেলার দায় নিতে চায় না কেউ

নিউজ ডেক্স : নালায় পড়ে মৃত্যু হয় আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়ার। রাত পোহানোর আগেই ঘটনাস্থলে বাঁশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘেরা।এর আগে একইভাবে মুরাদপুর মোড়ে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সালেহ আহমদ। ঘটনার দুইদিন পর সেখানে রশি টেনে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে কর্তৃপক্ষ। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, মৃত্যুর পর কেন এই উদ্যোগ?

নগরবাসী বলছেন, সেবা সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। নিজেদের অবহেলা থাকলেও দায় নিতে চায় না কেউ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নগরে যেসব এলাকায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সেসব এলাকায় দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। কিন্তু আশেপাশে আরও বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থাকলেও এখনও বেষ্টনী নির্মাণে নেওয়া হয়নি উদ্যোগ। এতে যেকোনও সময় ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো দুর্ঘটনা।  

এদিকে বারবার প্রাণহানির ঘটনায় টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। এখনও দুই সেবা সংস্থার মধ্যে চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। একে অপরকে দায় চাপানোই যেন তাদের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ‘কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলি’ অনুচ্ছেদের ৭ (১৮) এ উল্লেখ রয়েছে- শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ, নগরায়ন, পরিবেশ উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তি উন্নয়ন, বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, খাল ও নালা নর্দমার উন্নয়ন, উড়াল সেতু, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ট্রাম, মেট্রোরেল খাতে উন্নয়ন সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে সিডিএ। এছাড়া তৃতীয় অধ্যায়ের ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’ অনুচ্ছেদের ১৭ (চ) এ উল্লেখ রয়েছে- রাস্তা, নর্দমা, পয়ঃনিষ্কাশন, পানি সরবরাহের পাইপলাইন, সেতু, গলি, টেলিফোন লাইন, ইন্টারনেটের গ্লাস ফাইবার লাইন, বৈদ্যুতিক লাইন, গ্যাস লাইন ও কালভার্টের বিন্যাস বা পরিবর্তন করবে সিডিএ।

আবার একই অনুচ্ছেদে (ছ) এ উল্লেখ রয়েছে- রাস্তা সমতলকরণ, পাকাকরণ, পাথরকুচি বিছানো, পাথর বসানো, সংযোগকরণ, পয়ঃসংযোগ ও নর্দমার ব্যবস্থাকরণ এবং পানি সরবরাহ, আলোকিতকরণ এবং সাধারণভাবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ সংস্থান করে এমন স্যানিটারি সুবিধাদি প্রদান করবে সিডিএ। এছাড়া ওই অনুচ্ছেদের (ট) এ বলা হয়েছে, নির্গমন দ্বারসহ নর্দমা ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পও বাস্তবায়নের দায়িত্ব সিডিএ’র।  

এ বিষয়ে জানতে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ এবং প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া মেলেনি।

অন্যদিকে নিজেদের দায় এড়াতে সিডিএকে চিঠি দিয়েছে সিটি করপোরেশন। সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এ চিঠিতে স্বাক্ষর করেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহীদুল আলম।


চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নগরে সিডিএ’র বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এর মধ্যে পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত সড়ক অংশে অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প কাজে জননিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত। গত ২৫ আগস্ট জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতাধীন মুরাদপুর মোড়ের নালাতে এক পথচারী নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় নালায় পড়ে মারা যায়। ২৭ সেপ্টেম্বর অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের আওতাধীন এলাকা আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে চসিক কর্তৃক পূর্বে নির্মিত ফুটপাত সিডিএ কর্তৃক ভেঙে ফেলে। পার্শ্ববর্তী ড্রেন উন্নয়নপূর্বক ড্রেন স্ল্যাবের মাধ্যমে ফুটপাত নির্মাণকাজে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় এক শিক্ষার্থী নালায় পড়ে মারা যায়। পতেঙ্গা থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কারণে সড়কের বেহাল অবস্থা হওয়ায় মারাত্মক জনভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এতে চসিকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

পত্রে বলা হয়, যে কোনও সংস্থার প্রকল্প কাজ চলাকালীন যানবাহন এবং পথচারী চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থার ওপর বর্তায়। তাই সিডিএ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহে জননিরাপত্তা নিশ্চিত এবং স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করার অনুরোধ করা হয় সিডিএকে।

চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, কোনও ঘটনা ঘটলে সিডিএ সিটি করপোরেশনের ওপর দায় চাপায়। প্রকল্প যারা বাস্তবায়ন করবেন প্রাথমিকভাবে তাদেরই দায়িত্ব- নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যদি সিডিএ দায় এড়াতে চায়, তাহলে তারা চসিককে চিঠি দিক। তাহলেই এমন ঘটনার দায় কার-তা পরিষ্কার হবে।  

দুই সংস্থার কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, দুই সংস্থাই জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী। তাদের গাফিলতির কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে কিছু চুক্তি রয়েছে। এসব চুক্তির ফাঁকফোকর দিয়ে দুই সংস্থাই দায় এড়ানোর সুযোগ খুঁজছে। এসব না করে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ কমানোই তাদের কাজ হওয়া উচিত।

রাস্তায় খোলা ম্যানহোল নিয়ে ইতিপূর্বে উচ্চ আদালত বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জারি করেছেন রুল। সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষকে আদালতে তলব করা হয়, খোলা ম্যানহোলে পড়ে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনাও দেন আদালত।  

২০১৬ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যেসব ম্যানহোল ঢাকনাবিহীন অবস্থায় রয়েছে তা ১৫ দিনের মধ্যে সঠিকভাবে প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ। এছাড়া ২০১৪ সালে ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের পাইপে পড়ে মারা যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। এ ঘটনায় করা রিট মামলায় রেলওয়ে এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের অবহেলার দায়ে শিশু জিহাদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দেন হাইকোর্ট বিভাগ।  

নালায় পড়ে মৃত্যুর দায় সেবা সংস্থাগুলো এড়াতে পারে না বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ।

তিনি বলেন, চলাচলের রাস্তার মাঝখানে বা পাশে খোলা নালা বা স্ল্যাবহীন ম্যানহোল রাখার দায় প্রথমত রাস্তার তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। আবার রাস্তায় কোনও নির্মাণকাজ চলাকালে খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজন হতে পারে, সেক্ষেত্রে পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্মাণকাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থার। নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বের প্রকৃতি ও পরিধি উভয়ই কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মাধ্যমে উভয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা দৃশ্যমান হয় এবং টর্ট আইনে আইনগত প্রতিকারযোগ্য দাবি সৃষ্টি করে। এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এসব দুর্ঘটনা ‘অ্যাক্ট অব গড’ কিংবা ‘দৈব দুর্ঘটনা’র কোনটিই নয়। এটি আইনত ‘অবহেলাপ্রসূত মৃত্যু’। বাংলানিউজ