- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

নগরে দিনে ভাঙছে ১৫ সংসার

নিউজ ডেক্স : চার বছরের সংসার মিথিলা-শহীদ (ছদ্মনাম) দম্পত্তির। দেড় বছরের একটি পুত্র সন্তানও আছে তাদের। বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি করেন শহীদ। সকালে বের হলে ফিরেন রাতে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও প্রায় মিটিং অথবা অন্য কোনো সেমিনার থাকে। ফলে ব্যস্ততার জন্য ঠিকমত সময় দিতে পারেন না স্ত্রী-সন্তানকে। গত বছর করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশে লকডাউন শুরু হলে হোম অফিসের সুযোগ পায় শহীদ। খুশি হন স্ত্রী। আশা, এবার অন্তত স্বামীকে কাছে পাওয়া যাবে। স্বামীও ভাবে, স্ত্রীকে সময় না দেয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলবে। অথচ দুই মাস না যেতেই মনোমালিন্য শুরু হয় তাদের। কারণ, বাসায় থাকলেও সারাক্ষণ মোবাইল-ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে শহীদ। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে উল্টো ধমক খেতে হয় মিথিলাকে। এক পর্যায়ে স্বামীর অবহেলা সহ্য করতে না পেরে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় সে। সর্বশেষ গত মাসে শহীদকে তালাকের নোটিশ পাঠায় মিথিলা।

গত দেড় বছরের বেশির ভাগ সময় করোনা পরিস্থিতির জন্য ঘরবন্দী ছিল মানুষ। তার আগের বছরগুলোতে ব্যস্ত থাকা লোকগুলোর কাছে সুযোগ আসে পরিবারকে সময় দেয়ার। কিন্তু টানা ঘরে থাকতে থাকতে হিতে বিপরীত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে যায় সাংসারিক নানা জটিলতা। ফলে মিথিলার মত অনেকেই বেছে নেন বিচ্ছেদের পথ। এর মধ্য দিয়ে ভাঙছে সংসার। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই সারা দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছিল বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। ব্যতিক্রম ছিল না চট্টগ্রামও। তবে করোনাকালের কঠিন সময়ে বৃদ্ধির গতি ছিল বেশি। যেমন চলতি বছরের প্রথম সাড়ে আট মাসে নগরে দৈনিক ১৫টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সালিসি আদালতে। যা ২০২০ সালে ছিল ১৩টি। ওই বছরও করোনার জন্য বেশিরভাগ সময় ঘরবন্দী থাকতে হয়েছে লোকজনকে। এর আগে ২০১৪ সালে দৈনিক ৮টি, ২০১৫ সালে ৯টি, ২০১৬ সালে ও ২০১৭ সালে ১০টি করে, ২০১৮ সালে ১১টি এবং ২০১৯ সালে ১২টি আবেদন জমা পড়েছে।

চলতি বছরের এখনো সাড়ে তিন মাস বাকি। ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা আরো বাড়বে। করোনাকালে বাধ্য হয়ে ঘরবন্দী থাকার সময় স্বামী-স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি সহজেই একে অপরের চোখে পড়ছে। অন্য ব্যস্ততা না থাকায় পরষ্পরের দোষ-ত্রুটি ভুলে থাকার মাধ্যমে সমাঝোতার পথও এসময় সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে বেড়েছে বিচ্ছেদের ঘটনা। অবশ্য মানসিক চাপের পাশাপাশি করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট ও সামাজিক চাপও সংসার ভাঙার জন্য দায়ী।

সংসার ভাঙা কারণ : পারিবারিকভাবে ২০২০ সালের ৪ মার্চ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সাথে বিয়ে হয় ফৌজিয়ার (ছদ্মনাম)। বিয়ের চতুর্থ মাসে চাকরি হারায় তার স্বামী মিনহাজ (ছদ্মনাম)। এতে সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টুকটাক কথা কাটাকাটি। এমনই কথা কাটাকাটির পর অক্টোবর মাসে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যায় ফৌজিয়া। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি স্বামীকে তালাক নোটিশ পাঠায় সে। যা কার্যকরও হয়েছে। ফৌজিয়ার অভিযোগ, বেকার স্বামী সংসার চালাতে না পেরে যৌতুকের জন্য চাপ দিয়েছিল।

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যাওয়ার অজুহাতে চাকুরিচ্যুৎ করা হয় মিনহাজকে। পরে অনেক চেষ্টা করেও অন্যত্র চাকরি পায়নি। যার কারণে সংসারও টিকিয়ে রাখতে পারেনি সে। অর্থাৎ করোনার প্রভাবে সৃষ্ট অভাবও এ সময়ের বিবাহবিচ্ছেদগুলোর জন্য দায়ী।

গত বছরের নভেম্বর মাসে ভালোবেসে বিয়ে করেন ইপিজেডের একটি গার্মেন্টেসে কর্মরত শাহেদা ও করিম। বিয়ের দ্বিতীয় মাসে এসে চাকুরি ছেড়ে দেয় করিম। তার বক্তব্য শাহেদার আয়ে সংসার চলবে। সেটা মেনে নিতে না পারে করিমকে তালাক দেয় সে।

এ ধরনের বিবাহ বিচ্ছেদের একাধিক আবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, নানা কারণ রয়েছে সংসার ভাঙার। এর মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের বিরুদ্ধে অভিন্ন অভিযোগ ছিল- পরকীয়া, স্মার্ট ফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, বদমেজাজ ও সংসারের প্রতি উদাসীনতা।

আবার শুধু মাত্র স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর অভিযোগ হচ্ছে- মাদকাসক্তি, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে, স্ত্রীর আয়ে সংসার চালানোর মানসিকতা, চাকুরি করতে না দেয়া বা স্বাবলম্বী হতে বাধা দেয়া ও শারীরিক অক্ষমতা।

স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর অভিযোগ হচ্ছে- যৌথ পরিবারে থাকতে না চাওয়া, স্বামীর মা-বাবাসহ নিকাটাত্মীয়ের প্রতি সম্মান না দেখানো, ধর্মীয় রীতিনীতি না মানা ও সন্তান না হওয়া। ব্যতিক্রম কিছু অভিযোগও পাওয়া গেছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে। দেনমোহরের লোভেও বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই স্ত্রী স্বামীকে তালাক নোটিশ পাঠাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে চসিকের সালিসি আদালতে তালাকের নোটিশগুলোর ৫৫ শতাংশের বেশি ছিল স্ত্রীদের পক্ষে। অর্থাৎ নারীরাই বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বেশি নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে করোনাকালে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধিরও দাবি আছে। গত জুন মাসে এনএইচ জার্মানি এবং বেসরকারি সংগঠন সমাজকল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার (স্কাস) অনলাইন সংলাপে বলা হয়, করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতার শিকার ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। এই সময়ে ৯১ শতাংশ নারীর বাসায় কাজের চাপ বেড়েছে।

সাত বছরের ব্যবধানে সংসার ভাঙার হার দ্বিগুণের পথে: সিটি কর্পোরেশনের সালিসি আদালতে ২০১৪ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ৩ হাজার ২৬৮ জন আবেদন করে। চলতি বছর প্রথম আট মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন হাজার ৫৭২ জন আবেদন করেন। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ১৫টি আবেদন পড়েছে। ওই ধারা অব্যাহত থাকলে সাত বছরের ব্যবধানে বিয়ে ভাঙার হার প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।

এছাড়া ২০১৫ সালে তিন হাজার ৪৮৬ জন, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৯৬১ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৯২৮ জন, ২০১৮ সালে চার হাজার ৩৩১ জন, ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৫৫০ জন এবং ২০২০ সালে চার হাজার ৮৫৪ জন আবেদন করেন।

প্রসঙ্গত, বিবাহবিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী বা স্ত্রীকে প্রথমে লিখিতভাবে চসিক মেয়রকে জানাতে হয়। এটা এক ধরনের নোটিশ। একইসঙ্গে যাকে তালাক দিচ্ছেন তাকেও ওই নোটিশ পাঠাতে হয়। আবেদন পাওয়ার পর মেয়র নোটিশটি সালিসি আদালতে পাঠিয়ে দেন। আদালতে মেয়রের পক্ষে নিযুক্ত থাকেন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ)। বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করার আগে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকে তিন মাসে তিনবার নোটিশ দেয় চসিক। দুই পক্ষের কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই হাজির হলে সমঝোতার চেষ্টা চালান আদালত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আইন অনুযায়ী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

যা বললেন সালিসি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট : চসিকের সালিসি আদালতে নিযুক্ত স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস বলেন, সব স্তরের মানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত লোকজনই বিচ্ছেদের আবেদন করেন। অপ্রিয় হলেও সত্য করোনাকালে বিচ্ছেদের হার বেড়ে গেছে। এর অনেকগুলো কারণ হতে পারে। হয়তো অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে কলাপস (আর্থিক সক্ষমতা হারনো) হয়েছে। আবার করোনার জন্য দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো একে অপরের দোষ-ত্রুটি আর মেনে নিতে পারছে না। বলা যায়, সহনশীলতা কমে গেছে।

তিনি বলেন, খুব হৃদয় বিদারকও অনেক কেস দেখেছি। যেমন ছোট বাচ্চাকে রেখে মা চলে গেছে। অনেক মাকে দেখেছি প্রতিবন্ধী সন্তানের দায় নিচ্ছে না। আবার বিয়ের দুইদিনের মাথায়ও বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে।

সামগ্রিকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রায় সবগুলোই প্রায় অভিন্ন। যেমন স্মার্ট ফোনে আসক্তি, অতিরিক্ত রাগ, পরকিয়া এবং উচ্চ মাত্রার দেনমোহর। আবার চাকুরিজনিত জটিলতাও আছে। যেমন মেয়ে চাকুরি করতে চাইলে ছেলে বাধা দিচ্ছে। আবার অনেক সময় মেয়ে চাকুরি করলে ছেলে তার আয় দিয়েই সংসার চলুক সেটা চায়, তাই ছেলে আর কিছু করে না।

জাহানারা ফেরদৌস বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে এখন সবার মধ্যে সহনশীলতা কমে গেছে। যেমন একটা সময়, স্বামী বা তার আত্মীয়স্বজন কিছু বললে বউ চুপ করে থাকতেন। ইদানিং সেটা হচ্ছে না। এখন পাল্টা উত্তর করে। আবার অনেক সময় স্বামী রাগের মাথায় একটা চড়-থাপ্পড় দিলে সেটা ইস্যু হয়ে সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত মামলা করার প্রবণতাও রয়েছে। আছে যৌতুকপ্রথাও।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তারও প্রভাব পড়ে। প্রবাসে অবস্থানরত স্মামী হয় মায়ের কথা বিশ্বাস করে নয়তো স্ত্রীর। মানে মা এবং বউয়ের মধ্যে যে ব্যালেন্স করা দরকার তা করতে পারে না। পরে দেখা যায় এ কারণে সংসারও ভেঙে যাচ্ছে।

অনেক সময় তালাকের আবেদন করলেও বুঝিয়ে সর্ম্পক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটার হার খুব কম। চিকিৎসকগণ আইসিইউ’তে যাওয়া রোগীর কত শতাংশ বাঁচাতে পারেন। এখানেও তেমন। সাফল্যের হার দুই থেকে পাঁচ শতাংশ। যদি কখনো ২০ শতাংশ হয় তখন সাফল্য বলব। অনেক সময় দেখা যায়, সংসারের বয়স ২০-২৫ বছর হয়ে গেছে। এরপরও তালাকের আবেদন করেন। এক্ষত্রে দেখা যায়, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে গেছে। তারা হয়তো মায়ের বা বাবার পক্ষ নিচ্ছেন। ওই জায়গায় কাউন্সিলিং করলে ফেরানো যায়। দৈনিক আজাদী