ব্রেকিং নিউজ
Home | শীর্ষ সংবাদ | দখিনা হাওয়ার ফাগুন

দখিনা হাওয়ার ফাগুন

_______ ফিরোজা সামাদ _______

প্রথম যেদিন জীবনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনেছিলাম?
সে দিনটা ছিলো আগুন রাঙা ফাগুনের দিন,
আমি আনন্দচিত্তে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলে দেখলাম,হায়! এতো ফাগুনের দখিনা হাওয়া নয়!
এ যে চৈতালির শেষ কালবৈশাখীর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়!
যার কাব্যিক নাম হলো ব্যর্থতা ও একরাশ অবহেলা ||

আমি ভেবেছিলাম বর্ষার শতজলধারা, শরতের উষ্ণতা আর শীতের রুক্ষতা মিলেমিশে হয়তো আমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে এসেছে বুঝি আগুন রাঙানো ফাগুন নিয়ে !
কিন্তু ; নাহ্! দুয়ার খুলেই দেখি চৈত্রের তপ্তরোদকে মাড়ায়ে চৈতালি-কালবৈশাখীর ঝড় নির্লজ্জের মতো আমায় আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো যা ছিলো আমার কাছে অপ্রত্যাশিত একরাশ অবহেলার মতো ||

আমি চারিপাশে তাকালাম অসহায় চোখে
দেখতে চাইলাম আমার ভয়ার্ত চোখের করুণদশায় কারোর হৃদয়ে কোনো সকরুণ আর্তি বাজে কি-না?
অনেক করুণ আবেদন ছিলো আমার চোখের তারায়!
কিন্তু ; নাহ্! সেখানেও কোনো জনমানব হাত বাড়িয়ে ছিলো না আমার জন্য ||

বৃষ্টিহীন জমিন যেমন খড়খড়ে রোদে ফাটলে ফাটলে অদমনীয় চৌচির হয়ে ওঠে? ঠিক তেমনি একরাশ অবহেলাও আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিলো নিঃসঙ্কোচে মোহহীনতায়!
আমি অসীম সাহসের ডানায় ভর করে তোমাদের সেই অবহেলাকে দু’পায়ে মাড়ায়ে একদৌড়ে ফেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম,
ঠিক তখনই সম্মুখপানে তাকিয়ে দেখি উপেক্ষা আর ঘৃণা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে অবজ্ঞাভরে ||

তারপর আমি একটু চাতুরিতার আশ্রয় নিয়ে উপেক্ষা, ঘৃণা আর অবজ্ঞাকে বুকের মাঝে ধারণ করেই একদা গিয়েছিলাম তোমাদের কাছে আনন্দ ও উৎসবমূখর এক জলসায়! সেদিন তোমরা আমায় কী দিয়েছিলে?
ভুলে গিয়েছো হয়তো,আমি কিন্তু ভুলিনি!
তোমরা সেদিন আমায় দিয়েছিলে অপয়ার অপবাদ!
অনূঢ়া বিধবার মতো আঁজল ভর্তি তিরস্কার!
আমি সহাস্যে সেই অপবাদ ও তিরস্কারকে সঞ্চয় করে আমারই আঁচলভরে ফিরে এসেছিলাম তোমাদের জলসাঘর থেকে ||

কারণ,আমি যেনো বুঝে গিয়েছিলাম কোনোদিনও আমার জীবনে চৈতালি বা কালবৈশাখীঝড় ছাড়া নিটোল কোনো প্রেম বা ভালোবাসা আসবে না।
বুঝে গিয়েছিলাম যাপিত জীবন মানে কেবল যুদ্ধ
আর যুদ্ধ! এখানে স্বস্তির কোনো স্থান নেই!
ভালোবাসার ঠাই নেই! এখানে স্বপ্নরা বাসা বাঁধেনা, মন কখনো কল্পনার বেসাতি নিয়ে রঙের ছবি আঁকে না ||

আমি সেদিন খেকে ভুলে গেলাম হারানো দিনের গান!
গান ও কবিতার আলপথ ধরে কারা হেঁটে যায়
দূর সীমানায় তা জানার কৌতুহল বা দুঃসাহস করিনি কোনোদিন!
এতকিছুর পরে আমার নজরুলের মতো বিদ্রোহী হওয়ার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিলো! কিন্তু ; আমার শক্তি
ও সাহসই ছিলো না তখন ||

তবে আমার ছিলো শুধু ধৈর্য ও মেনে নেয়ার বিনয়!
আর অভিজ্ঞতার ঝোলায় সঞ্চিত ছিলো একরাশ
অবহেলা, উপেক্ষা, ঘৃণা আর অবজ্ঞা ||

এখন মনে করতে পারছিনা, তবে কবে যেনো তোমরা
দয়া করে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলে একবার! সে চোখে হয়তো তাচ্ছিল্য ছিলোনা, কেমন যেনো একটু কাঁপা আবেগ মিশ্রিত মায়াভরা ছিলো সে দৃষ্টি ||

ততোদিনে আমার বুকে জ্বলে উঠেছিলো বিদ্রোহের আগুন! তাই তোমাদের দৃষ্টির সে ভাবার্থ আমি হয়তো বুঝতেই চাইনি! আজ বুঝতে পারছি ওইটুকুই ছিলো তোমাদের কাছে আমার যা পাওয়া! তোমাদের ঋণ শোধ করেছিলে ||

কিন্তু ; আমার বোধ জাগ্রত হয়েছিলো।
আত্মসম্মান টগবগিয়ে উঠেছিলো হৃদয় গহীনে!
তাই একদিন আমার বিদ্রোহী নজরুল হতে ইচ্ছে হলো! জীবনানন্দের কবিতার মতো ভাসতে ইচ্ছে হলো! প্রেমের জোয়ারে ভেসে রবী ঠাকুরের গানের সুরে সুর মেলাতে চাইলো আমার মন ||

তোমরা ছিলে দমকা হাওয়া, আমি ঝড়ে পড়া পাতা। আমি তোমাদের অবহেলা ও ঘৃণার চাদর ছিড়ে টুকরো টুকরো করে অবজ্ঞার কলঙ্কের দাগ মুছে উপেক্ষার সীমারেখার বেড়া ভেঙে দিয়েছিলাম একদা আমি!
স্বপ্নপ্রবণ মানুষ আমি! ভেবেছিলাম, অবহেলা, অবজ্ঞা, ঘৃণা,উপেক্ষা আর কলঙ্কের সব চিহ্ন সব মুছে দেবে একদিন হয়তো ফাগুনের দখিনা সমীরণ!
তারপরে একদিন জীবনের স্বর্ণালি দিনগুলো ফেলে এসে দেখলাম, একি! আমার যে সবকিছু বদলে গেছে! কোথায় হারিয়ে গেছে বাল্য,কৈশোর, ও যৌবনের দিনলিপি? আজ অবহেলা, অবজ্ঞা, উপেক্ষারা আমায়
ভয় দেখাতে পারছে না, কিন্তু ; আমার সেই পোড় খাওয়া দিনগুলো কখন যেনো বড্ড রঙিন হয়ে ফিরে এসেছিলো জীবনে ||

জীবনের পরন্ত ফাগুনে এসে সবকিছু জয় করে
আজ আমি জলের রঙ দেখে বলে দিতে পারি কতোটুকু পানি তোমাদের মায়াবী অশ্রুজল,
কতোটুকু জল তোমাদের মেকিত্বের?
আজ তোমাদের চোখের উপর চোখ রেখে অনায়াসে বলে দিতে পারি, কতোটুকু সম্মান জমা করেছো আমার জন্য?
আর কতোটুকু শুধুই অভিনয়?
আজ আমি অন্তর্দৃষ্টিতে এও দেখতে পারি তোমাদের বাহারি পোষাকের আড়ালে কতোটুকু মিহিন কষ্ট চেপে রেখে মুখে লাবণ্যময় হাসি ধরে রেখে হয়েছো সোনার পাথরবাটি ||

তোমরা জেনে রেখো! এ আমার কবিতা নয়,
এ হলো দীর্ঘশ্বাসে পরিপূর্ণ এক জীবনের আখ্যান,
হ্যা! একদা এই জীবনও হতে পারতো এক কবিতা,
যদি পেয়ে যেতো সঠিক সময় দখিনা হাওয়ার ফাগুন ||

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!