- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

তানিয়া এখন আবার স্কুলে যাচ্ছে

JAHAN

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : উম্মে হেনা তানিয়া (১৪)। সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির একজন মেধাবী ছাত্রী। ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন ছিল লেখা পড়া শিখে নামকরা আইনজীবী হবে। নারী এবং নির্যাতিত–নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। উকিল হওয়ার কথা মাথায় রেখে মানবিক বিভাগ নিয়ে লেখা পড়া করছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দিনের পর দিন লেখা পড়ায় মনোযোগ বাড়িয়েছে। গত অর্ধ বার্ষিকী পরীক্ষায় মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়েছে। ভাল ছাত্রী হওয়ায় তানিয়া ক্লাসেও সবার মধ্যমণি। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো বাল্যবিয়ে। সুদর্শন পাত্র, বিদেশে ছিল, এখন চট্টগ্রাম শহরে ব্যবসা করে। অনেক টাকার মালিক। বিয়েতে যৌতুকও দিতে হবে না। এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ উম্মে হেনা তানিয়ার বাবা–মা। বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত। দুই পক্ষের আত্মীয়–স্বজনদের দাওয়াত দেয়ার কাজও প্রায় শেষ। ভাড়া করা হয়েছিল সাতকানিয়ার পরশমনি কমিউনিটি সেন্টার। সব ঠিক থাকলে গত ১৯ অক্টোবর তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এত দিনে হয়তো নববধূর বেশে সংসারের কাজ কর্মে মহাব্যস্ত থাকতে হতো অপ্রাপ্ত বয়স্ক তানিয়াকে। বিয়ের কথা চুড়ান্ত হওয়ার আগে তাঁর মতামতের প্রয়োজন মনে করেনি বাবা–মাসহ বিয়ের আয়োজকরা। আর যখন জেনেছে তখন বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না তানিয়া। সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল আমি এখন বিয়ে করবো না। পড়া লেখা করবো। লেখা পড়া শিখে নিজের স্বপ্ন পুরন করে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো। কিন্তু না, অভিভাবক, আত্মীয়–স্বজনরা তাঁর পিছু ছাড়ছিল না। সর্বশেষ বাবার অসুস্থতার কথা বলে তানিয়াকে বাল্য বিয়েতে রাজি করার চেষ্টা করলো। পরে সবার নানা মুখী চাপ এবং বাবার অসুস্থতার কথা চিন্তা করে নিজের লালিত স্বপ্নকে কবর দিয়ে তানিয়া বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো। সে অনুযায়ী সব আয়োজন শেষ। বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তানিয়াও। ওই মুহূর্তে বাঁধ সাধলেন সাতকানিয়া থানার ওসি মোঃ রফিকুল হোসেন, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, প্রধান শিক্ষক সুনীল কুমার ও তানিয়ার সহপাঠীরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁর বাবা–মাকে স্কুলে ডেকে বাল্যবিয়ে দিতে নিষেধ করেন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বাল্যবিয়ের বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করেন।

নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের বিয়ের খবর পেয়ে সাতকানিয়া থানার ওসি মোঃ রফিকুল হোসেন বাল্যবিয়ের বরসহ দুই পক্ষের অভিভাবকদেরকে থানায় তলব করেন। বর, বরের পিতা, কনের পিতা এবং দুই পক্ষের আত্মীয়–স্বজনদেরকে নিয়ে থানায় বৈঠক করেন। এসময় ওসি দুই পক্ষের লোকজনকে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করার অনুরোধ করেন। ওসির বক্তব্য শুনে বর–কনে পক্ষের লোকজন বাল্যবিয়ে না দেয়ার বিষয়ে একমত হন। বিশেষ করে বর মোঃ ইকবাল হোসেন বাল্য বিয়ে করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরও বাল্যবিয়ের বরকে একেবারে নিরাশ করেননি থানার ওসি। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কনের পরিবর্তে বরের হাতে তরতাজা ফুল তুলে দিয়ে সান্ত্বনা দেন ওসি রফিকুল হোসেন। একই বৈঠকে বর ও কনে প ের লোকজন মুঠোফোনের মাধ্যমে বিয়ের দাওয়াত বাতিল করেন। বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়ায় মহাখুশি উম্মে হেনা তানিয়া। বই খাতা নিয়ে আবার স্কুলে ছুঁটে যেতে পারবে, বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতে পারবে। ওসি সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্ঠায় আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে তানিয়ার স্বপ্ন। এখন আবার বন্ধু–বান্ধবদের সাথে মনের আনন্দে স্কুলে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষিকারাও নিজেদের প্রিয় ছাত্রীকে আবার ক্লাসে পেয়ে আনন্দ বোধ করছেন। বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে পড়া লেখায় মননিবেশ করেছে তানিয়া।

পুলিশ ও দুই পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার ছদাহা এলাকার মোজাহের মিয়ার মেয়ে কেঁওচিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মানবিক বিভাগের ছাত্রী উম্মে হেনা তানিয়ার সাথে সাতকানিয়া পৌরসভার মধ্যম রামপুর এলাকার আহমেদ হোসেনের পুত্র ব্যবসায়ী মোঃ ইকবাল হোসেনের বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল।

বাতিল হওয়া বাল্যবিয়ের বর মোঃ ইকবাল হোসেন জানান, ওসি সাহেব বাল্য বিয়ে সম্পর্কে আমাদেরকে অনেক কথা বলেছেন। এছাড়া এটা দেশের প্রচলিত আইনে অবৈধ। ফলে আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করবো না বলে জানিয়ে দিয়েছি।

কনে উম্মে হেনা তানিয়া জানায়, আমার স্বপ্ন ছিল লেখা পড়া করে নামকরা উকিল হবো। সেই স্বপ্নকে মনের মধ্যে ধারণ করে মানবিক বিভাগ নিয়ে লেখা পড়া করছি। গত অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে আমি প্রথম হয়েছি। কিন্তু পরিবারের লোকজন হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। আমি বিয়েতে প্রথমে রাজি ছিলাম না। পরে বাবার অসুস্থতার কথা চিন্তা করে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে বিয়েতে রাজি হই। এখন বিয়ে বন্ধ হওয়ায় আমি অবশ্যই খুশি। আমি লেখা পড়া করতে পারবো। এখন আমি যদি স্বাভাবিকভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে আইন বিষয়ে লেখা পড়া করবো। নামকরা আইনজীবী হবো। এখন অবশ্যই পরিবার, শিক্ষক– শিক্ষিকা ও সহপাঠীদের কাছ থেকে আমি সহযোগিতা পাচ্ছি।

উম্মে হেনা তানিয়ার পিতা মোজাহের মিয়া জানান, ওসি সাহেবের কথা শুনে মনে হয়েছে আমরা বড় ধরনের ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আমি মেয়েকে আর বাল্যবিয়ে দেব না। অন্য মানুষকেও বাল্য বিয়েতে নিরুৎসাহিত করবো।

কেঁওচিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুনীল কুমার জানান, উম্মে হেনা তানিয়া এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। গত অর্ধ বার্ষিকী পরীক্ষা সে মানবিক বিভাগে প্রথম হয়েছে। আমি চাইনি এরকম মেধাবী একজন মেয়ে বাল্য বিয়ের কারণে ঝরে পড়ুক। তাঁর জীবনটা নষ্ট হোক। এ কারণে বিষয়টি আমি পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবারক হোসেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজিম শরীফ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ রফিকুল হোসেনকে অবগত করি। মেয়েটি এখন আবার নিয়মিত স্কুলে আসছে দেখে আমার আনন্দ লাগছে। সে কিন্তু একদম ভেঙে পড়েনি। আমরা নানা ভাবে তাকে সাহস দিচ্ছি। আশা করছি তানিয়া অনেক ভাল রেজাল্ট করবে এবং তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে।

কেঁওচিয়া উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট ব্যাংকার মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, আমি কমিটিতে আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে শ্রেণি কক্ষে গিয়ে ছাত্র–ছাত্রীদের সাথে লেখা–পড়ার বিষয়ে কথা বলেছি। একই সাথে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেছি। উম্মে হেনা তানিয়া নামের মেয়েটির বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর পাওয়ার সাথে সাথে তাঁর অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি। বাল্যবিয়ে দিতে নিষেধ করেছি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে বিষয়টি জানিয়েছি। প্রধান শিক্ষকও তাঁর বাবা–মাকে বিদ্যালয়ে ডেকে এনে বিয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। থানার ওসি দুই প ের লোকজনকে ডেকে বৈঠক করে বাল্যবিয়ে বন্ধের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে মেয়েটি এখন আবার স্কুলে আসছে। লেখা পড়া শুরু করেছে। এটা খুব আনন্দের বিষয়। আগামীতেও এলাকায় এধরনের বাল্য বিয়ে হতে দেব না। তিনি আরো জানান, তানিয়ার এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত তাঁর যাবতীয় খরচ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি বহন করবে। তাঁর পরিবারের এক টাকাও খরচ হবে না। আর উচ্চ শিক্ষার যাবতীয় খরচ আমি ব্যক্তিগত ভাবে চালাবো।

সাতকানিয়া থানার ওসি মোঃ রফিকুল হোসেন জানান, নারীর অগ্রযাত্রায় প্রথম বাঁধা হলো বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে মানেই মেয়ে শিশুর অধিকার লঙ্গন করা। এটি এক ধরনের নির্যাতন। বাল্যবিয়ে সামাজিক ও আইনগত অপরাধ। কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা লাভের জন্য নির্দিষ্ট একটা সময় প্রয়োজন। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। তিনি আরো জানান, উম্মে হেনা তানিয়ার বাল্যবিয়ের খবর পাওয়ার পর আমি বর এবং দুই পরিবারের অভিভাবকদের থানায় ডেকে আনি। পরে উভয় পক্ষের সাথে বৈঠক করে বাল্যবিয়ের কূফল এবং এ বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা দিই। বিস্তারিত বুঝিয়ে বলার পর তারা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের বর আমাকে সহযোগিতা করেছে। সে বিস্তারিত শুনার পর নিজ থেকে বলে দিয়েছে বাল্য বিয়ে করবে না। ফলে বরের হাতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে তুলে না দিয়ে ফুল দিয়ে বিদায় দিয়েছি। ওসি আরো জানান, আমি যতদিন সাতকানিয়ায় থাকবো ততদিন একটি বাল্য বিয়েও হতে দেব না।