- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যেন ‘মৃত্যুকূপ’

নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। ১৪৭ কিলোমিটারের সড়কটিতে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। যাতে ঝরে পড়ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও ঢালু সড়ক, অবৈধ গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক ও চালকদের বেপরোয়া চালনা এ চার কারণেই মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন খাতের সহযোগী অন্যতম মহাসড়কটি।

অভিযোগ রয়েছে, হাইওয়ে ও স্থানীয় পুলিশের মাসোহারার মাধ্যমে চলে হাজার হাজার অবৈধ যানবাহন। অবৈধ যানবাহনের তালিকায় রয়েছে, রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি অটোরিকশা, রুটপারমিটবিহীন চার চাকার লেগুনা, ম্যাজিক, লক্করঝক্কর সবুজ টেম্পু, মেয়াদোত্তীর্ণ বাস, ইট-মাটি-বালি টানার ডাম্পার ও ফিটনেসবিহীন অসংখ্য মাইক্রোবাস পুরো মহাসড়ককে মৃত্যুকূপ বানিয়ে চলেছে। পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা কিংবা অনেকে মন্ত্রী-এমপির নাম ভাঙিয়েও এসব অবৈধ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন। যে কারণে দুর্ঘটনারোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দৈনিক আজাদী

জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের প্রায় প্রত্যেকটি স্পটে বছরে অগুনিত দুর্ঘটনা ঘটে। গত কয়েক বছরে মহাসড়কটিতে কয়েক শত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গতকাল ২২ মার্চ সকালে সাতকানিয়ার কেরানিহাট এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের চাপায় পটিয়া পৌরসভার মাঝেরঘাটা এলাকার বাসিন্দা শুক্কুর নামের এক পরিবহন ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। ঠিক ১২ ঘন্টা আগে লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্য এলাকায় লবণবোঝাই কার্গো ট্রাকের সাথে একটি রুট-পারমিট বিহীন লেগুনা সংঘর্ষে ১৫ লেগুনা যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি মহাসড়কের পটিয়ার শান্তিরহাটে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে স্বামী-স্ত্রীসহ তিন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় দম্পতির একমাত্র শিশুপুত্র সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়।

২০১৯ সালের ২৯ মার্চ লোহাগাড়ার চুনতি জাঙ্গালিয়ার সীমান্ত গেট এলাকায় আরেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা একই পরিবারের তিনজনসহ ৮জন প্রাণ হারায়। ওইসময় একটি এসি বাসের সাথে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তারও দেড় মাস আগে ৩ ফেব্রুয়ারি পটিয়ার ভাইয়ার দিঘীর পাড় এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের সাথে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৪ যাত্রী নিহত হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ১৯ আগস্ট দিবাগত রাত ১২.০৫ টায় শাহ আমানত সেতুর টোল প্লাজায় প্রবেশের মুখে একটি সিএনজি অটোরিকশাকে একটি যাত্রীবাহী বাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের দুই সন্তান ও অটোরিকশার চালকসহ ৫ জন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। দুর্ঘটনার কবলে পড়া যানবাহনের ছোট যানবাহনগুলো ছিল অবৈধ। যেগুলো রুট পারমিট না নিয়েই পুলিশকে ম্যানেজ করে চলে। সরু মহাসড়ক এবং অবৈধ যানবাহনের আধিক্য বেড়ে যাওয়ার কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রাম কক্সবাজার আন্তঃজেলা বিলাসী চেয়ারকোচ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, যেসব বাস ও চেয়ারকোচের ডকুমেন্ট নবায়ন করা নেই, সেগুলো সরকারি বিধি মেনেই আগামী জুন মাসের মধ্যে প্রত্যেকটি গাড়ি ডকুমেন্ট হালনাগাদ করে নেবে। জুনের পরে ডকুমেন্টবিহীন কোন গাড়ি চালানো যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি অত্যন্ত ব্যস্ত। কিন্তু সড়কটি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত সরু। মহাসড়কটিতে অসংখ্য বাঁক রয়েছে। আবার যে পরিমাণ বৈধ গাড়ি চলে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অবৈধ গাড়ি চলে। লেগুনা, ম্যাজিকসহ ছোট অবৈধ গাড়িগুলোর কারণে বড় গাড়িগুলো প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। পুলিশকে ম্যানেজ করেই এসব অবৈধ গাড়িগুলো চলাচল করছে।’

দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশের ওসি ইয়াসির আরাফাত বলেন, শনিবার দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া ট্রাকটি আমাদের কাস্টডিতে আনা হয়েছে। চার চাকার গাড়িটি একেবারে দুমড়েমুচড়ে গেছে। গাড়িটির নাম্বারটিও নেওয়া সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘মহাসড়কটির লোহাগাড়া চুনতি অংশের যাত্রীদের চলাচলের জন্য কোন ছোট গাড়ি নেই। এ সুযোগে লেগুনাগুলো চলে। তবে নিবন্ধিত হলেও এসব গাড়ির কোন রুট পারমিট নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।

আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুছা বলেন, লেগুনার কোন রুট পারমিট নেই। অবৈধভাবে মহাসড়কে চলাচল করছে। অবৈধ গাড়িগুলোর বেশিরভাগ চালকের বয়সও ১৮ বছর হয়নি। আমরা সবসময় অবৈধ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরে বলে আসছি। যারা এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, তাদের মাধ্যমেই এসব অবৈধ গাড়ি চলাচল করে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) দোহাজারীর নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের শিকলবাহা হতে দোহাজারী পর্যন্ত সাড়ে ২৭ কিলোমিটার সড়কটি বর্তমানে ৫.৫ মিটার প্রসস্ত। আবার সড়কটির বাঁকগুলো সোজাকরা সহ সবমিলিয়ে সাড়ে ২৯ কিলোমিটার সড়ক ১০.৩ মিটারে উন্নীত করার জন্য একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চুনতি যে অংশে শনিবার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেটি রাস্তার পজিশন ভালো। ওখানে সড়কটি ৭.৩ মিটার প্রসস্ত। মূলত বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে।

হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে যেকোন অবৈধ গাড়ি, রেজিস্ট্রেশনবিহীন ও রুটপারমিটবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে আমরা সবসময় অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলি।’ অবৈধ গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশের মাসোহারার অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ অবৈধ গাড়ি চলাচলকে উৎসাহিত করে না। তারপরেও আমাদের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ এলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেই।’