- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

করোনাকালে আয় কমে যাওয়ায় চাপ পড়েছে জনজীবনেও

নিউজ ডেক্স : করোনাকালে নানা প্রতিকূলতায় শোচনীয় গ্রামীণ অর্থনীতি। মানুষের আয় কমে যাওয়ায় চাপ পড়েছে জনজীবনেও। শহর থেকে গ্রামে যাওয়া মানুষের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক প্রবাসী গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছেন। এই প্রতিকূলতা কাটাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া না হলে মানুষের কষ্ট বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি কিংবা খাদ্য সহায়তা বাড়ানো সম্ভব না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরী এবং জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ১৫ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে চাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এদের মধ্যে এক লাখের বেশি মানুষ দেশে এসে আটকা পড়েছেন। আবার কারো কারো ভিসা সংকটসহ নানা কারণে ফেরার পথও বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশের অর্থনীতিতে নানাভাবে ভূমিকা রাখলেও এখন নিজেরাই কষ্টে পড়ে গেছেন। গ্রামে আটকা পড়া এসব প্রবাসীর অনেকের কোনো আয় বা আয়ের উৎসও নেই। এরা বিদেশে চাকরি কিংবা ব্যবসা করেন। দেশে বেড়াতে আসেন। যে পরিমাণ টাকা আনেন তা খরচ করে আবার গিয়ে কাজ করেন। বিদেশ থাকা অবস্থায় যে পরিমাণ টাকা পাঠান তা-ও পরিবারের ভরণ-পোষণসহ সংসারের প্রাত্যহিক কাজে খরচ হয়ে যায়। অধিকাংশ প্রবাসী দেশে পাকা ঘর তৈরি করেন। অনুৎপাদনশীল খাতে পুরো জীবনের উপার্জন খরচ করে ফেলার মতো প্রবাসীর সংখ্যাও কম নয়। দেশে এরা কাজ করেন না। তাই আয় করারও সুযোগ থাকে না।

চট্টগ্রাম জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা চট্টগ্রামের অন্তত ১৫ লাখ মানুষ বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা পাঠান। চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে প্রতি মাসে ৫শ কোটি টাকা আসে বিশ্বের নানা দেশ থেকে। রেমিটেন্স হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে আসা এই টাকার বেশিরভাগ চলে যায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে, যা দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে পুরো বছর। বাজারের সবজি বিক্রেতা থেকে স্বর্ণের দোকান পর্যন্ত সর্বত্রই থাকে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের ইতিবাচক প্রভাব। এই টাকার বড় অংশ খরচ হয় প্রবাসী পরিবারগুলোর প্রাত্যহিক খরচে। কিন্তু করোনাকালে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিদেশ থেকে আসা টাকার পরিমাণ কমে গেছে। আবার অনেক প্রবাসী দেশে এসে আটকা পড়েছেন। এতে করে গ্রামের দোকানপাট থেকে শুরু করে সর্বত্রই অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। বেচাবিক্রি নেই অনেক দোকানে। রোজা ও ঈদ চলে গেছে। কোরবানির ঈদও ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতির ঝিমিয়ে পড়া ভাব বাড়ছেই।

জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালে প্রবাসীদের জীবনযাত্রায় ধস নেমেছে। করোনা শুরু হওয়ার আগে এসে বহু প্রবাসী আটকা পড়েছেন। অন্তত তিন মাস আগে আসা প্রবাসীও আটকা পড়েছেন প্রামে-গঞ্জে। চট্টগ্রামে ১ লাখের বেশি প্রবাসীর ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে যেতে পারেননি। ফ্লাইট বন্ধ থাকায় অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আবার অনেকের ভিসা থাকলেও চড়া দামে ফ্লাইটের টিকেট কিনে যেতে পারছেন না। চট্টগ্রামে এই ধরনের আটকে পড়া লাখখানেক প্রবাসী দুর্দিন মোকাবেলা করছেন।

প্রবাসীদের পাশাপাশি শহর থেকেও প্রচুর লোক গ্রামে ফিরে গেছেন। শহরে চাকরি হারিয়ে কিংবা অফিস-দোকান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ভাড়া বাসার বাড়তি খরচ থেকে বাঁচতে অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন গ্রামে। এতে করে গ্রামে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার কথা থাকলেও ঝিমিয়ে পড়েছে।

সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুরের ইমরান উদ্দিন ওমানের সালালায় থাকতেন। শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। চার মাস আগে দেশে এসে আটকা পড়েছেন। শুরুতে দুই হাতে টাকা খরচ করলেও এখন বিড়ি খাওয়ার পয়সাও নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আত্মীয়-স্বজন থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন যাবে বুঝতে পারছি না। কবে আবার বিদেশ যেতে পারব কিংবা যেতে পারব কিনা তা-ও বুঝতে পারছি না। বিদেশ যেতে না পারলে এখানে যে কিছু একটা করব, তারও সুযোগ পাচ্ছি না। আগে বাজারে গিয়ে শ’খানেক টাকা শুধু চা-নাস্তায় খরচ করতাম। এখন পুরো সংসারের জন্য একশ টাকা খরচ করতে পারছি না।

সীতাকুণ্ডের মীরেরহাট বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, দোকানে বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে। মানুষ চা-ও খাচ্ছেন না। সীতাকুণ্ডের একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, তিনি গত চার মাসে এক ভরি স্বর্ণও বিক্রি করেননি। দোকানও খুলেন না। খুললেও কিছুক্ষণ বসে চলে যান।

রাউজানের পথেরহাটের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বলেন, অবস্থা ভয়াবহ। আগে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসত এখন তার সিকিভাগও আসছে না। টাকা ব্যাংকে জমানো দূরের কথা, আমানত এবং সঞ্চয়পত্র ভাঙার হার উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে সংকট চলছে। চট্টগ্রামের গ্রামীণ অর্থনীতিতে রেমিটেন্স প্রবাহের প্রভাব আছে। প্রবাসীদের আয় কিংবা দেশে টাকা পাঠানোর পরিমাণ কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু ব্যাংকে নয়, বাজারের দোকান থেকে শুরু করে গ্রামীণ জীবনযাত্রার সর্বত্রই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আর্থিক অভাব প্রকট হওয়ায় অনেকে শুধু প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। অনেকে নানাভাবে অর্থ সাশ্রয় করার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকে প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নানামুখী চাপে গ্রামীণ অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গ্রামীণ অর্থনীতি চাপে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স গ্রামীণ অর্থনীতির বড় শক্তি। প্রবাসীদের প্রেরিত টাকায় গ্রামাঞ্চলের নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রেমিটেন্স প্রবাহ থমকে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দেয়া ধস দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

কুয়েতের কোটা প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, প্রচুর লোক দেশে আটকা পড়েছেন। প্রচুর লোক বিদেশে চাকরি হারিয়েছেন। দুটোই আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি। চাকরি হারানো প্রচুর লোক দেশে ফেরত আসবেন। সেটি আরো বড় ধরনের হুমকি তৈরি করবে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং খাদ্য সহায়তার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। যা সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে সতর্ক করে দেন তিনি। দৈনিক আজাদী