- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

এমন ঘটনা ঘটাবো যে দেহাংশ খুঁজে বের করার সময়ও মিলবে না

111057zahran-hashim-mastermind-be

নিউজ ডেক্স : জঙ্গি হামলার ভয়াবহতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। তার মধ্যেই ফের ব্যর্থতার অভিযোগ সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। ইস্টারের সকালে হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে ইতোমধ্যেই তাওহীদ জামায়াতের নেতা জাহরান হাশিমের নাম উঠে এসেছে। আত্মঘাতী হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সে দেশের গোয়েন্দারা। আরো জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরেই জিহাদি কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন হাশিম। সোশ্যাল মিডিয়ায় নাশকতার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। এমনকি স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যেও তাকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দেশের পূর্বে উপকূলবর্তী শহর কট্টানকুড়িতে দুই কামরার বাড়িতে মা-বাবা ও চার ভাই বোনের সঙ্গে থাকতেন হাশিম। তারা বাবা ছিলেন পেশায় ফেরিওয়ালা। আবার ছিঁচকে চোর বলে দুর্নামও ছিল। সেই অবস্থাতেই বেড়ে ওঠা হাশিমের। তবে ছাত্র হিসাবে প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন তিনি। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। মাত্র ১২ বছর বয়সে জামিয়াতুল ফালাহ আরবি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অল্পদিনের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নজরে পড়ে যান।

কিন্তু বুদ্ধিমত্তার জন্য যেমন সকলের নজর কেড়েছিলেন হাশিম, তেমনই একগুঁয়ে, গোঁড়া স্বভাব কারও নজর এড়ায়নি। একদিকে তিন বছরের মধ্যে কোরআন তটস্থ করে ফেলেছিলেন। তারপর নখদর্পণে এনে ফেলেছিলেন ইসলামি আইন। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ততই অবাধ্য হয়ে উঠছিলেন। এমনকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেও মতবিরোধ দেখা দেয় তার। উদারপন্থী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। তার কলেজের প্রাক্তন সহ অধ্যক্ষ এসএম আলিয়ার জানান, ‘আমাদের পড়ানোর আদব-কায়দা একেবারেই পছন্দ ছিল না ওর। আমরা যেভাবে কোরআন ব্যাখ্যা করতাম, তার ঘোর বিরোধী ছিল হাশিম। ওর বিশ্বাস ছিল কট্টর ইসলামে’।

আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৫ সালে তাই কলেজ থেকে হাশিমকে বহিষ্কার করা হয় বলে জানান তিনি। এসএম আলিয়া বলেন, ‘শেষবার বাবার সঙ্গে দেখেছিলেন তাকে। তার প্রায় ১৪ বছর পর, সংবাদমাধ্যমে আত্মঘাতী জঙ্গি হাশিমকে দেখতে পেলেন’।

কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ২০০৬ সালে দারুল আথার নামে একটি মসজিদে যোগ দেন হাশিম। সেখানের ম্যানেজমেন্ট কমিটিতেও জায়গা পেয়ে যান। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি। অন্য সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তিন বছরের মধ্যেই মসজিদের চাকরিটি খোয়াতে হয় তাকে। দারুল আথারের ইমাম এমটিএম ফাওয়াজ জানান, কারো মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করতেন না হাশিম। নিজে থেকেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতেন। এমনকি ধর্মীয় গোঁড়ামি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মহিলাদের চুরি ও কানের দুল পরা নিয়েও আপত্তি ছিল তার।

স্কুলে পড়ার সময় হাশিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ইউসুফ মুহম্মদ তৌফিকের। পরে হাশিমের অনুচরেও পরিণত হন তিনি। তিনি জানান, নিজের পছন্দ মতো কোরানের উল্লেখিত নির্দেশের ভুল অর্থ উদ্ধৃত করা বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল হাশিমের। তার জেরেই তিনমাসের জন্য ধর্মোপদেশ দেওয়া থেকে তাকে নিষিদ্ধ করে মসজিদ কমিটি। তারপরই  রাগে সেখান থেকে চলে যান হাশিম। নিজের অনুগামীদের নিয়ে দল তৈরি করেন। তাদের নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ধর্মীয় বক্তৃতা করতেন।  নিজের মতো করে কোরান ব্যাখ্যা করে শোনাতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের। ২৩ বছর বয়সে ১৪ বছরের একটি কিশোরীকে হাশিম বিয়ে করেন বলেও জানা গিয়েছে।

উদারপন্থী সুফি সাধকদের বিরুদ্ধেও একসময় হাশিম উঠে পড়ে লেগেছিলেন বলে জানিয়েছেন সুফি মসজিদগুলির দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংগঠনের সচিব সাহলান খলিল রহমান। তিনি জানান, ২০০৪ সালে কট্টানকুড়ির একটি সুফি মসজিদে গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৬ সালে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বেশ কিছু বাড়িতে। এমনকি তাদের এক নেতাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয় প্রকাশ্য। সুফি সাধকদের ধর্মান্তকরণের উদ্দেশ্যে মৌলবাদী ওয়াহাবিরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছিল বলে দাবি তার। আর সেই সুযোগেই সুফি সাধকদের হেনস্থা করতে নেমে পড়েন হাশিম। সুফিদের প্রার্থনার সময় হলে সময় মাইক বাজিয়ে তাদের উদ্দেশে কটুক্তি করতে শুরু করেন। এমনকি ২০১২ সালে নিজের আলাদা মসজিদও শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানো বলেও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

সোশ্যাল মিডিয়ারও অপব্যবহার করতে শুরু করেন হাশিম। মুসলিম ছেলে-মেয়েদের মগজধোলাই করতে অনলাইনে নানারকম ভিডিও পোস্ট করতে শুরু করেন। জিহাদের ডাক দেন। হুমকি দেন নাশকতারও। একট ভিডিওতে এমনও বলতে শোনা যায় তাকে, ‘এমন ঘটনা ঘটাবো যে দেহাংশ খুঁজে বের করার সময়ও মিলবে না। আল্লাহকে যারা অপমান করে তাদের নরকে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে ছাড়বো’।

তার পরই গত ২১ এপ্রিল, ইস্টারের সকালে শ্রীলঙ্কায় তার নেতৃত্বে আটটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে নারী, পুরুষ এবং শিশু মিলিয়ে ২৫০ জন প্রাণ হারান। হামলাকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশে ফেরত, উচ্চশিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের সন্তান বলে তদন্তে উঠে এসেছে। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম তাদের নেতৃত্বে থাকা জাহরান। শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একগুঁয়ে কিশোর থেকে মধ্য তিরিশের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার যাত্রা কিন্তু দেশের মধ্যেই, প্রশাসনের নাকের ডগায়।

সূত্র : আনন্দবাজার