- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

এবার ঈদযাত্রা কতটুকু দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনা মুক্ত হবে?

(ফাইল ছবি)

(ফাইল ছবি)

নিউজ ডেক্স : সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সড়ক–মহাসড়কে দেখা যাবে ঘরমুখো মানুষের স্রোত। ঈদ আনন্দ উদযাপনে পরিবার–পরিজনের কাছে ফিরতে দল বেঁধে ছুটবে মানুষ। তবে সড়কপথে ঘটে অনাকাঙিক্ষত দুর্ঘটনা। অকালে ঝরে প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর নিত্যদিনের হলেও ঈদ মৌসুমে তা আরো বাড়ে। এর সাথে থাকে যানজট। প্রতি বছরই দেখা যায় এমন চিত্র। ফলে বেশিরভাগ সময় ঈদযাত্রা হয় নিরানন্দের।

সম্প্রতি বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে সরকার বলছে, আগের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, এবারের ঈদযাত্রা গতবারের চেয়ে আরো স্বস্তিদ্বায়ক হবে।

আগামী ১৬ জুন ঈদুল ফিতরের সম্ভাব্য দিন ধরে নিয়ে তিন দিনের সরকারি ছুটি ঠিক করা হয়েছে ১৫ থেকে ১৭ জুন। এর আগে মানুষ ছুটবে গ্রামে। প্রশ্ন হলো, এবার ঈদযাত্রা কতটুকু দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনা মুক্ত হবে? দুর্ঘটনা মুক্ত ঈদযাত্রা কি সম্ভব?

সাধারণ যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাদের হিসাব মতে, ঈদ মৌসুমে চট্টগ্রাম থেকে ২২ লাখ যাত্রী বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আসন্ন ঈদযাত্রা প্রসঙ্গে সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, এবারও সড়ক–মহাসড়কগুলো যাত্রীদের জন্য সুখকর হবে না। ভাঙাচোরা সড়কের সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে কোনো কোনো সড়কে দুর্ভোগের পাশাপাশি উল্টো পথে চলাচলকারী পরিবহনের সংখ্যা থাকবে বেশি। পরিবহন উল্টো পথে চললে দুর্ঘটনার আশংকা বেশি থাকে।

তিনি বলেন, এবার ঈদ মৌসুমেও দূরপাল্লার গণপরিবহনের সংকট থাকবে। এতে বিভিন্ন সিটি রুটে চলাচলকারী যানবাহনগুলোও দূরপাল্লার যাত্রী টানবে। চালকের অনভিজ্ঞতার কারণে দুর্ঘটনার আশংকা রয়ে যায়। বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন, দেশের মহাসড়কগুলোতে সরকারিভাবে যেসব ব্ল্যাক স্পট বা দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটার সার্ভে অনেক পুরনো। দীর্ঘদিন ধরে এসব নিয়ে নতুন কোনো সার্ভে করা হয়নি। এর মাঝে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে মহাসড়কগুলোর সাথে আঞ্চলিক সড়কগুলোর বিভিন্ন সংযোগ স্থাপন হয়েছে। ওইসব সংযোগে নতুন করে আরো বেশ কিছু ব্ল্যাক স্পট রয়েছে বলে আমরা মনে করছি। আমাদের মতে, বর্তমানে সারা দেশে এমন ব্ল্যাক স্পটের সংখ্যা হবে হাজারের মতো। কিন্তু দুর্ঘটনাপ্রবণ এসব স্থানের সংস্কারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। জানা গেছে, সংগঠনটি আজ বুধবার সড়কের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে যাচ্ছে।

কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম জোনের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আফতাব হোসাইন খান। তিনি গতকাল আজাদীকে বলেন, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম অংশে বড় ধরনের কাঠামোগত কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু স্বাভাবিক আছে। এখন যেসব সংস্কার কাজ হচ্ছে তা টুকটাক। তাতে গাড়ি চলাচলে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যেসব ব্ল্যাক স্পটের ব্যাপারে কথা বলা হচ্ছে, চট্টগ্রামে আপাতত এ ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জোনের প্রধানের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা।

ঈদে বাড়ি ফিরতে সড়ক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ঢাকা–চট্টগ্রাম, ঢাকা–টাঙ্গাইল, ঢাকা–ময়মনসিংহ, ঢাকা–সিলেট, ঢাকা–মাওয়া, ঢাকা–আরিচা জাতীয় মহাসড়ক। এর মধ্যে ঢাকা–চট্টগ্রাম ও ঢাকা–টাঙ্গাইল মহাসড়কে উন্নয়নকাজ চলছে। এক হিসাব বলছে, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাড়কসহ অন্যান্য সড়কগুলোতে এখনো প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে।

গতকাল ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে এলপিজি বহনকারী একটি ট্যাংক লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রোড ডিভাইডারের ভেঙে চলন্ত একটি মিনি পিকআপ ও লেগুনার উপর উল্টে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে পিকআপের চালক ও হেলপার নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরো ৫ জন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দু দিনে শুধুমাত্র ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে সড়কে এক নারী পথচারীসহ চারজন মারা গেছেন। শুক্রবার কুমিরা এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে পেছন থেকে একটি পিকআপ ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনায় ওই পিকআপের চালক ও তার সহকারী মারা যান। একই দিন সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে চলস্ত একটি কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় এক নারী পথচারী নিহত হন। এ সময় আহত হয়েছেন আরো একজন। এর আগের দিন ফৌজদারহাট এলাকায় একটি ফিলিং স্টেশনের সামনে চলন্ত একটি কাভার্ডভ্যান পেছন থেকে একটি ট্রাককে ধাক্কা দিলে ট্রাকটির চালক নিহত হন। চলতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় আরো প্রাণহানি ঘটে।

এর আগে গত চার মাসের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। প্রতিবেদনে গত জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামসহ সারা দেশে চার মাসে ১ হাজার ৮৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১২৩ জন নিহত ও ৫ হাজার ৫৫৮ জন আহত হন বলে সংগঠনটি জানিয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবারের দুর্ঘটনায় নিহত ১.৪৪ শতাংশ এবং আহত ৮.৩১ শতাংশ বেড়েছে বলে জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা হচ্ছে ৭৩৯৭ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন তখন ২০ জনের অধিক মারা গেছেন।

এর আগে দুর্ঘটনা নিয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দশ বছরের পরিসংখ্যানে বলেছে, তখন বাংলাদেশে ২৯,৪৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬,৬৮৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ২১,৫৪৮ জন।

সড়ক–মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক হারে প্রাণহানির পর সম্প্রতি দুয়েক বছর হলো বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন ও সমালোচনার মুখে সরকার এ বিষয়ে মনোযোগী হয়। এছাড়া জাতিসংঘও ২০১১ হতে ২০২০ সালকে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার দশক ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশও উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কয়েক বছর আগে থেকে কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন সড়ক–মহাসড়কগুলো সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বা দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান চিহ্নিতকরণের পর প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ চালানোসহ আরো কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, মহাসড়কে দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে সওজের টেকনিক্যাল সার্ভিসেস উইং গত ২০১৪–১৫ অর্থবছর থেকে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ‘জাতীয় মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানসমূহে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়ন’ নামক এ প্রকল্পটির কাজ তখন থেকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত বছর এ প্রকল্পটিতে ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে ঢাকা–চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বা স্থানগুলো চিহ্নিতকরণের পর সেইসব বাঁক অপসারণ ও সহজীকরণের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে বুয়েট। সমীক্ষায় ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বিভিন্ন জাতীয় মহাসড়কে ২২৭টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান বা ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা–চট্টগ্রাম ফোর লেন প্রকল্পের আওতায় ৩১টি ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত হয়েছিল।

তবে চট্টগ্রাম জোনের ব্ল্যাক স্পটগুলো সমীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এগুলোর সংস্কারের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনাপ্রবণ এই স্থানগুলোর সংস্কার কাজ না হওয়ায় দুর্ঘটনার আশংকা রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু হেনা মোহাম্মদ তারেক বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে দেশের অন্যান্য জায়গায় ব্ল্যাক স্পট সংস্কার কাজের প্রকল্পটি চালু থাকলেও ঢাকা–চট্টগ্রাম এবং ঢাকা–সিলেট রুটে আপাতত প্রকল্পটি চালু নেই। আগামীতে ছয় লেন প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এ মহাসড়ক ঘিরে। তখনই ওই প্রকল্পটির মধ্যে ব্ল্যাক স্পটগুলোর সংস্কার কাজ করা হবে। ইতিমধ্যে প্রকল্পটির ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই এর অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তবে ব্ল্যাকস্পট নিয়ে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন বাঁক ঠিক করার পাশাপাশি সাইনবোর্ড লাগানোসহ অন্যান্য কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, মহাসড়কে নির্মাণকাজে অনেকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটছে। সেই বিষয়গুলো আগে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। জমি অধিগ্রহণ কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অন্য দিকগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। এমন স্থানগুলো বুয়েট নির্দিষ্ট করেছে, যা মেরামত করে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার কাজ চলছে। মূলত নকশায় ত্রুটি, বাঁক, স্থানগত সমস্যা, সড়কের ধরন ও যান চলাচলের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।

সওজের নেওয়া ওই উদ্যোগে মহাসড়কের বাঁক সরলীকরণ, ইন্টারসেকশন উন্নয়ন, পথচারী ক্রসিংয়ের উন্নয়ন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, সাইন সিগন্যাল ও রোডম্যাপিং স্থাপনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ করার কথা।

সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা–আরিচা মহাসড়ক ছিল সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ মহাসড়কের বেশ কয়েকটি ব্ল্যাক স্পট উন্নয়নে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ায় দুর্ঘটনার মাত্রা কমেছে।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গত বছর করা একটি পর্যবেক্ষণে সড়ক নির্মাণে প্রকৌশলীদের ভুলের পাশাপাশি দুর্ঘটনার জন্য চালক, বিআরটিএ, মালিকের ভুল, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গাফিলতি এবং চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে দায়ী করা হয়েছে। এগুলোর সাথে সড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহনও দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশ দায়ী বলে মনে করা হয়। কিন্তু এসব যানবাহনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকারী কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না বলে অনেকেই জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম নগরীসহ আন্তঃজেলার সড়ক–মহাসড়কগুলোতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলের মাত্রা কমছে না। এছাড়া ২০১৬ সালের ২ জুলাই উদ্বোধনের পর ঢাকা–চট্টগ্রাম চার লেনের কিছু কিছু জায়গা ভাঙতে শুরু করেছে।

বিশিষ্টজনেরা বলছেন, দেশে ব্যাপক হারে নতুন সড়ক, ব্রিজ, সড়ক প্রশস্তকরণসহ নানা উন্নয়ন হচ্ছে। এর সাথে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনাও। অথচ সড়ক প্রশস্তকরণ হলে দুর্ঘটনা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ঘটনার বর্তমান চিত্র উল্টো।

এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঈদযাত্রায় সড়ক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি মন্তব্য করেছেন, এবারের ঈদযাত্রা গতবারের তুলনায় আরো স্বস্তিদায়ক হবে।

স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে মন্ত্রণালয় সজাগ রয়েছে। বৃষ্টিজনিত ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। অতি বৃষ্টিতে যান চলাচলে ধীরগতি হলেও যানজট হবে না। আমাদের প্রচেষ্টা অবিরত, অব্যাহত। আশা করা যাচ্ছে, এবারের ঈদযাত্রা গতবারের চেয়ে আরো স্বস্তিদায়ক হবে। তিনি লেখেন, বর্ষায় অতি বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা সড়কের মেরামত কাজ আগামী ৮ জুনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কোন ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে সড়ক সম্পর্কে কোনোরূপ আতঙ্ক সৃষ্টি না করতে সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। পদ্মা সেতুর চারটি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ ৫৫ ভাগ শেষ হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ ইতোমধ্যে দেশি–বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্নের প্রকল্প কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। শাহ আমানত সেতুর দু প্রান্তের সড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ কাজ এগিয়ে চলেছে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী রেলওয়ে ওভারপাসের দু লেইন ইতোমধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে এখন আর যানজট হচ্ছে না। আগামী ১৫ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হবে। তখন সম্পূর্ণ যানজটমুক্ত হবে ফেনী রেলওয়ে ওভারপাস এলাকা। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ২য় কাঁচপুর, ২য় মেঘনা ও ২য় গোমতী সেতুর নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগে শেষ হতে যাচ্ছে। এছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে ঢাকা–সিলেট মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। সাসেক প্রকল্পের আওতায় ১১টি উড়াল সেতু ও রেল ওভারপাস এবং ১০টি আন্ডারপাস নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে।

ঈদযাত্রা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেছেন, এ বছর রমজানের আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করেছে মন্ত্রণালয়। সম্পৃক্ত করা হয়েছে সকল স্টেক হোল্ডারদের। এবার সমন্বয় সভাগুলো করা হয়েছে মাঠপর্যায়ে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া, ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের ভুলতা, ঢাকা–টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর এবং ফেনীতে চারটি সমন্বয় সভা হয়। এ সকল সভায় জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ, পরিবহন মালিক–শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণ ছিল।

এদিকে আসন্ন ঈদের আগের চার দিন এবং পরের চার দিন চব্বিশ ঘণ্টা সারা দেশের সিএনজি স্টেশনসমূহ খোলা থাকবে। ঈদের আগের তিন দিন মহাসড়কে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পচনশীল দ্রব্য, গার্মেন্টস সামগ্রী, ঔষধ, কাঁচা চামড়া এবং জ্বালানি বহনকারী যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত।

উল্টোপথে গাড়ি চালানোর কারণে সৃষ্টি হয় অনাকাঙিক্ষত যানজট। যত প্রভাবশালীই হোক কিংবা ভিআইপি হোক, এমনকি তিনি হলেও উল্টোপথে গাড়ি চালালে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন সেতুমন্ত্রী। ঈদের সময় যানজট এবং অতিরিক্ত চাপ এড়াতে এলাকাভিত্তিক গার্মেন্টসমূহ ধাপে ধাপে ছুটি দেওয়া এবং খোলার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এছাড়া বাস টার্মিনাল এবং মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে এবং সড়কপথে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমার, মলম পার্টি ও অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য রোধে সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ সজাগ থাকবে। মহাসড়কে যানবাহনের গতি অব্যাহত রাখতে ঈদের পূর্বের সাত দিন এবং পরে সাত দিন সুনির্দিষ্ট পূর্ব তথ্য ব্যতীত আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সড়কের উপর মোটরযান থামানো যাবে না। কোনোভাবেই ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে দেওয়া যাবে না। ঢাকা মহানগরীতে যত্রতত্র পার্কিং বন্ধে মোবাইল কোর্ট চালানো হবে। সড়ক–মহাসড়কের যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো–নামানো যাবে না।

জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের জন্য বলা হয়েছে। বাইশটি জাতীয় মহাসড়কে সিএনজি চালিত অটোরিকশা এবং নন–মোটরাইজড্‌ যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি আরোহী থাকবে না। প্রত্যেক আরোহীকে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে।

যানজট ও দুর্ভোগ এড়াতে সেতুসমূহের টোল আদায়কারী সকল বুথ চব্বিশ ঘণ্টা খোলা রাখা হবে। দ্রুত টোল আদায় করতে যানবাহনের মালিক ও চালকদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টোলের অর্থ হাতে রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। ফেরিঘাটে গাড়ি পারাপারে অতিরিক্ত ফেরি মজুদ রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দ্রুত সরিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু সেতু, মেঘনা সেতু ও গোমতী সেতুসহ দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে রেকার ও ক্রেন রাখার জন্য বলা হয়েছে। অনাকাঙিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত বড় ধরনের দুর্ঘটনা পরবর্তী দ্রুত উদ্ধারকাজ পরিচালনায় হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।

অনভিজ্ঞ, লাইসেন্সবিহীন চালকের মাধ্যমে গাড়ি না চালাতে এবং চালকদের একটানা ও অতিরিক্ত ট্রিপ না দেওয়ার জন্য পরিবহন মালিকদের অনুরোধ জানান সেতু মন্ত্রী। সড়কপথের দু পাশের সিএনজি স্টেশনের টয়লেটসমূহ ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য বলা হয়েছে। যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে মহানগরী এবং জাতীয় আঞ্চলিক মহাসড়কের উভয় পাশে কোনো ধরনের অস্থায়ী এবং ভাসমান বাজার বসানো যাবে না।

মন্ত্রী বলেন, ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে সকল সরকারি দপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জরুরি বলে মনে করি। এছাড়া মহাসড়কের পাশের সকল স্তরের জনপ্রতিনিধিগণ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি হতে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত প্রায় একশ নব্বই কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। গতি পেয়েছে আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য। কমেছে ভ্রমণ সময়। মুখোমুখি সড়ক দুর্ঘটনা এখন নেই বললেই চলে। প্রকল্পের আওতায় এ মহাসড়কে ২৩টি সেতু, ২৪২টি কালভার্ট, ৩টি রেলওয়ে ওভারপাস, ১৪টি সড়ক বাইপাস, ২টি আন্ডারপাস, ৩৪টি স্টিল ফুটওভার ব্রিজ, ৬১টি বাস–বে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কটিকে দৃষ্টিনন্দন করতে মিডিয়ানে লাগানো হয়েছে নানান প্রজাতির ফুলগাছ।

ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ি হতে কাঁচপুর পর্যন্ত অংশ ইতোমধ্যে আট লেনে উন্নীত করা হয়েছে। জাপানি সহায়তায় নির্মাণ করা হচ্ছে ২য় কাঁচপুর, ২য় মেঘনা, ২য় গোমতী সেতু। সেতু তিনটির নির্মাণ কাজ নির্দিষ্ট সময়ের ছয় মাস আগেই শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া এ প্রকল্পে প্রায় সাতশ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে যাচ্ছে; যা দেশের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনন্য নজির। সেতু তিনটি নির্মিত হলে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ আর কোনো যানজট থাকবে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

পার্বত্য এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর এবং উন্নয়নবান্ধব করতে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ব্যাপক কার্যক্রম। দুর্গম পাহাড়ের উপর থানচি–আলিকদম সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ সড়ক। বিসিআইএম করিডোরের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে বালুখালী–ঘুমধুম সড়ক। দেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেরানীহাট–বান্দরবান সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ এগিয়ে চলেছে।

পাহাড় ধসের পর জরুরি ভিত্তিতে স্বল্পসময়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় চট্টগ্রাম–রাঙামাটি সড়কের যোগাযোগব্যবস্থা পুনরায় সচল করা হয়েছে। অস্থায়ীভাবে একটি বেইলি সেতু নির্মাণসহ ১২৮টি পয়েন্টে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত করা হয়েছে। স্থায়ী মেরামতের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। নির্মাণ করা হয়েছে তবলছড়ি কনক্রিট ব্রিজ। নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ নানিয়ারচর সেতু। চট্টগ্রাম–রাঙামাটি সড়কের ৩৭ কিলোমিটার মেরামত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রাঙামাটি–বান্দরবান সড়কের বান্দরবান অংশের ৩১ কিলোমিটারের কাজ চলমান রয়েছে। রাঙামাটি–মানিকছড়ি–মহালছড়ি–খাগড়াছড়ি সড়কের কাজ গত অর্থবছরে সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দুর্গম এলাকায় যোগাযোগ স্থাপনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ব্যাপক কার্যক্রম। এ জেলায় ৪৬টি ব্রিজ এবং ১৩টি কালভার্ট নির্মাণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে ১৪টি ব্রিজ এবং ১১টি কালভার্টের নির্মাণ শেষ হয়েছে। চলমান রয়েছে ৩২টি ব্রিজ এবং ২টি কালভার্টের কাজ। এছাড়া জাপানি সহায়তাপুষ্ট ইস্টার্ন ব্রিজ ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় চট্টগ্রাম–খাগড়াছড়ি সড়কে ১৪টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে সিন্ধুকছড়ি–মহালছড়ি সড়কের কাজ। মাটিরাঙ্গা–তানইক্যাপাড়া ও খাগড়াছড়ি–পানছড়ি সড়কের সংস্কার শেষ হয়েছে। চলমান রয়েছে রামগড়–জালিয়াপাড়া সড়কের কাজ।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা বলে আসলেও যখন রাস্তাঘাটের দিকে তাকাই, তখন এগুলোর দৃশ্যমান কোনো কাজ বাস্তবায়িত হতে দেখি না। এতে করে সড়কে দুর্ঘটনার আশংকা থেকে যায়। এ ব্যাপারে সরকারের আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র : দৈনিক আজাদী