- Lohagaranews24 - https://lohagaranews24.com -

আসামি নয়, সাক্ষী হচ্ছেন বাবুল আকতার

333_135

নিউজ ডেক্স : চাকুরিচ্যুত পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার চার্জশিট আজ অথবা কালকের মধ্যে আদালতে জমা দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মো. কামরুজ্জামান। এ মামলার বাদি বাবুল আকতার।

ঘটনার পর মিতু হত্যায় বাবুল আকতার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও তা নাকচ করে দেন তার শ্বশুর-শাশুড়ি। ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে ডিবি কার্যালয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়ার পর মিতু হত্যায় বাবুলকে ঘিরে অভিযোগের ডালপালা মেলতে থাকে।

এডিসি কামরুজ্জামানের ভাষ্য, দুই বছর তদন্ত করেও মিতু হত্যায় বাবুলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। ফলে বাবুল আকতারকে বাদ দিয়েই প্রস’ত করা হয়েছে চার্জশিট। তাকে চার্জশিটে এক নম্বর সাক্ষী করা হচ্ছে। শ্বশুর-শাশুড়ির দাবি, মিতু খুনে বাবুলই জড়িত। পরকীয়ার জেরে বাবুলের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ পরিকল্পনা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের কমপক্ষে ছয় মাস আগে। চট্টগ্রামে ডাকার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণও দিয়েছি। বাবুলকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া হলে আদালতে তারা নারাজি দেবেন।

শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের প্রশ্ন, মিতু খুনে বাবুল জড়িত না থাকলে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হলো কেন ? ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে তাকে কেন ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো ? তদন্ত কর্মকর্তা বাবুলের বডিগার্ড, গাড়ির ড্রাইভারকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না? মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এডিসি কামরুজ্জামানেরও পাল্টা প্রশ্ন, মিতু হত্যায় জড়িত থাকার প্রমাণ না পেলে বাবুলকে কিভাবে আসামি করব? কী কারণে মিতু খুন হলেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে এডিসি কামরুজ্জামান বলেন, ‘সব উত্তর চার্জশিটে মিলবে’।

মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পরকীয়ার জেরে বাবুল আমার মেয়েকে খুন করিয়েছে। মিতুকে খুন করতে তার সোর্স মুছাকে নির্দেশ দেয় বাবুল। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যায় অংশগ্রহণকারী ওয়াসিম এবং আনোয়ারও জানিয়েছেন, তারা ঘটনার তিন-চার দিন আগে মিতুকে খুনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হত্যার পর ঘটনাস’লের আশপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, একটি মোটর সাইকেলের সামনে ছিলেন মুসা, এরপর আনোয়ার ও পেছনে মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম। প্রথমে মিতুকে মোটর সাইকেল দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। ওয়াসিম মিতুকে গুলি করে, আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা নবী তার বুকে, হাতে ও পিঠে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে।

সিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম নগরে জঙ্গি নির্মূলে বাবুল আকতারের সাহসী ভূমিকা ছিল। এ কারণে ঘটনার প্রথম দিকে জঙ্গিরাই ছিল মিতু খুনের মূল সন্দেহভাজন। ঘটনাস’লের আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মোটর সাইকেলে করে আসা খুনিরা সিগারেট টানছে। এছাড়া মিতুকে গুলি করার পর আরেকজন তাকে ছুরিকাঘাত করছে। এসময় মিতুর ছেলেকে হাত ধরে আটকে রাখে বাবুল আকতারের সোর্স মুছা।

পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জঙ্গিরা কখনো সিগারেট ফুঁকবে না। তাদের হত্যার ধরন ভিন্ন। এছাড়া খুন করে প্রমাণ রাখে না জঙ্গিরা। এসব বিষয় বিশেষ করে জঙ্গিরাই মিতুকে খুন করতে পারে এমন ধারণা থেকে সরে আসে পুলিশ। শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মিতুকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করিয়ে জঙ্গিরা করেছে বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল বাবুল আকতার।’ খুনের পরপর বাবুলের পক্ষে অবস’ান নিয়েছিলেন কেন? জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে মিতুর সঙ্গে বাবুলের বনিবনা হচ্ছিল না। এজন্য বাবুল আমার মেয়েকে খুনই করে ফেলবে, তা কল্পনাতেও আসেনি।’

মিতু হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়ে গতকাল সোমবার দুপুরে জানতে চাইলে নগর কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘মিতু হত্যাকে ঘিরে বাবুলের বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। কিন’ এ খুনে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। বক্তব্য জানতে গত তিন দিন ধরে বাবুল আকতারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে পাওয়া যায়নি এবং এসএমএস দিলেও জবাব দেননি।

মিতু হত্যায় যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত তা হচ্ছে বাবুল আকতারের সোর্স কামরুল সিকদার মুছা। দুই বছরেও এ মুছার হদিস পায়নি পুলিশ। মুছার স্ত্রী পান্না আকতারের দাবি, তার স্বামীকে ২০১৬ সালের ২২ জুন নগরের বন্দর থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এরপর থেকে মুছার খোঁজ নেই। পুলিশের ভাষ্য, মুছাকে ধরা গেলে মিতু খুনের রহস্য উদঘাটন করা যেত। তবে সে মুছা কোথায়, আদৌ কি সে বেঁচে আছে নাকি গুম হয়ে গেছে তা নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। ফলে মিতু হত্যার নির্দেশদাতা কে? সে প্রশ্ন অজানা থেকে গেল জনমনে। মুছার স্ত্রীর দাবি নাকচ করে দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা এডিসি কামরুজ্জামান।

ঘটনার পর মিতু খুনে জড়িত থাকার সন্দেহে শাহ জামান ওরফে রবিন ও আবু নাছের গুন্নু নামে দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মিতু হত্যায় তাদের জড়িত থাকার তথ্য পায়নি পুলিশ। প্রায় দুই বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান তারা। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, মিতু হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল মুছা, ওয়াসিম, নবী, আনোয়ার, রাশেদ, শাহজাহান ও কালু। অস্ত্র সরবরাহ করেছিল ভোলা।

ওয়াসিম, আনোয়ার, ভোলা, মুছার ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু এবং শাহজাহানকে মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। নবী ও রাশেদ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। পলাতক আছে মুছা ও কালু। গত বছর ১ জুলাই সাইদুল জামিন পেয়েছেন। সম্প্রতি মিতু হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র মামলায় জামিন পান ভোলা। তবে তিনি মিতু হত্যা মামলায় কারাবন্দি আছেন।

২০১৬ সালের ২৬ জুন গ্রেফতারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ওয়াসিম ও আনোয়ার। তারা মুছার নির্দেশেই মিতু হত্যকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন। মিতু খুনের ৫ মাসের মাথায় মুছাকে ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ। সিএমপি সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার। পুরস্কার ঘোষণাকে ‘নাটক’ বলে মন্তব্য করেন মুছার স্ত্রী পান্না। পান্নার দাবি, চোখের সামনেই তার স্বামী মুছাকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। পুলিশ মুছার হদিস অবশ্যই জানে।

মিতু খুনের পর পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, জঙ্গিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। তবে তদন্তে জঙ্গির সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ। এরপর তদন্তে নানা মোড়, মিতু খুনে নীরব থাকার কারণে সন্দেহের তীর ক্রমশ বাবুলের দিকেই যেতে থাকে। এক সময় মিতুর পরকীয়ার কথা উঠলেও পরে আসে বহ্নি নামে মেয়ের সঙ্গে বাবুল আকতারের পরকীয়ার কাহিনী। তদন্তে নানা নাটকীয়তার পরেও বিগত দুই বছরে উদঘাটন হয়নি কে ছিল মিতু খুনের নির্দেশদাতা।

এদিকে ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে তাকে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় তার শ্বশুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে বাবুল আকতারকে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। মামলার বাদিকে আসামির মতো তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করায় হত্যাকাণ্ডের কারণ নিয়ে সেসময় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের জন্য বাবুল আকতারকে ইঙ্গিত করে খবর প্রকাশিত হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরের ও আর নিজাম রোডে নিজের শিশু সন্তানের সামনে গুলি করে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় মিতুকে। এ ঘটনায় বাবুল আকতার বাদি হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্তের মধ্যেই বাবুল আকতার, তার বাবা-মা ও মিতুর বাবা-মা পৃথক সময়ে নগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে এসে তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছেন। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন বাবুল আকতার। নানা নাটকীয়তা শেষে গতবছর ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সূত্র : সুপ্রভাত বাংলাদেশ