ড. মুহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ : সময়টা ছিল ১৯৯৫ ঈসায়ী। সবেমাত্র আলিম পরিক্ষা শেষ করেছি। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারনের বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তখন থাকতাম ঢাকার মীরহাজীবাগ এলাকার এক ছাত্র মেচে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা সকলের চিন্ত-চেতনায়। আমার চিন্তার জগতে দুঃশ্চিন্তার রেখা অংকিত হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো নাকি মাদরাসায় কামিল পর্যায় শেষ করে কর্ম জীবনে প্রবেশ করবো ? আমি ছিলাম পুরোপুরি আলেম পরিবারের সদস্য। আমার আব্বার মধ্যে এমন ধারণা খুব কঠিনভাবে দানা বেঁধেছিল যে, কামিল শেষ না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে পড়াশুনা সম্পূর্ণ হয় না বরং ছাত্ররা উত্তম চরিত্র ও দ্বীনদারি থেকে সম্পূর্নরূপে দূরে সরে যায়। আমাদের পরিবারে এর আগে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সাহস করেননি, ঐ সেকেলে ধ্যান ধারণার প্রভাবে। সকলের একটাই ধারণা; কামিল শেষ না করলে আলেম হওয়া যায় না। এই পুরানো ধারণা যৌক্তিকভাবে খন্ডন করার কোন বাস্তব প্রমাণ আমার কাছে না থাকায় চিন্তার জগত থেকে দুশ্চিন্তায় অংকিত রেখা মোচন করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সহপাঠিদের বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে দৌড়ঝাঁপ আমার টেনশনের মাত্রা আরও বাড়াতে লাগল। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো।
আমি তখন কক্সবাজারের এক বড় ভাইয়ের সূত্র ধরে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া,ঢাকা-র আল্লামা কাশগরী (র.) ছাত্রাবাসে থাকতাম। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়ার ছাত্র ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত বিষয়গুলোর মধ্যে আল-কুর’আন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়টি আমার হৃদয়পটে নাড়া দিল। এ বিষয়ে অনার্স পড়ার প্রচন্ড আকাংখা হৃদয়ে জাগ্রত হলো। আবার চট্টগ্রাম থেকে কুষ্টিয়ার দুরত্বের কথা মনে পড়লে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা ফিকে হয়ে উঠল। সে সময় অনলাইন ব্যবস্থার প্রচলন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব নিয়মে নির্ধারিত আঞ্চলিক ব্যাংক থেকে ফরম সংগ্রহ করতে হতো। মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকার কিছু ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী তাদের একজনকে কুষ্টিয়া পাঠিয়ে ভর্তি ফরম উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত নিলে আমিও তাদের সাথে যোগদিলাম। এভাবে অন্যের সহযোগিতায় ফরম উত্তোলন ও জমা দিয়ে যথারীতি ১৯৯৫ সালের রমাদান মাসে কুষ্টিয়া পৌঁছলাম ভর্তি পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য। দুরত্বের কারণে বাড়ী থেকে প্রথম দিকে বাধার সম্মুখীন হলেও তা ক্রমান্বয়ে দূর হয়ে যায়। আল-কুর’আন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হয়ে ঢাকার চক বাজার থেকে সিলেবাসভূক্ত কিছূ আরবি তাফসীর কিনে আব্বাকে দেখালে বিশ্ববিদ্যালয় সর্ম্পকে তার ভুল ধারণা পাল্টে যায়।
বিদ্বগ্ধ শিক্ষকমন্ডলীর আরবি লেকচার ও আল-কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে মনোমুগ্ধকর তাফসীর শ্রেণীকক্ষ যেমন আলোকিত হতো তেমনিভাবে আমাদের জীবন চলার পথের আলোও আমরা খুঁজে পেতাম। আধুনিক মন মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরাও আল-কুরআনে অনার্স পড়ার কথা শুনলে বিরূপ মন্তব্য করার সাহস করত না, কারণ এটা মহান আল্লাহর নাযিলকৃত ওহী। পার্থিব সাময়িক লাভের আশায় যারা দ্বীনি শিক্ষা বাদ দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অহংকার ও দম্ভ সহকারে পদচারনা করত তাদের সামনে প্রথম দিকে অনার্স বিষয়ের নাম বলতে সংকোচবোধ করতাম। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান আমার সংকোচ বুঝতে পেরে ধমকের সূরে বললেন, তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়ের উপর অনার্স পড়ছো, এটা তোমাকে মনে রাখতে হবে।
আল-কুরআনের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রী জীবনের লক্ষ্য ও আখিরাতের গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কুর’আন বুঝার রাজপথ খুঁজে পেয়েছি। যে জ্ঞানের গভীরতা সীমাহীন সে জ্ঞানের সাগরে সাতরানোর আলাদা একটি অনুভুতি রয়েছে,যেখান থেকে আল্লাহর কালামের নিত্য নতুন রহস্য উদঘাটিত হয়। যে কালামের মধ্যে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহের লেশমাত্র নেই। যার ব্যাখ্যা পৃথিবীর সমুদ্রসমূহের সমস্ত পানিকে কালি বানালেও লিখে শেষ করা যাবে ন্।া আল্লাহ স্বয়ং যে কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। সে বিষয়টি সারা জীবনের চিন্তা ও গবেষণার খোরাক একথা ভাবতেও গা শিহরিয়ে উঠে।
মাস্টার্স শেষ করলাম ২০০২ সালে। সকলের মাঝে বিদায়ের করুণ সুর বাজতেছিল। দীর্ঘদিনের ক্যাম্পাস জীবনের ইতি টেনে কুর’আনের আলো বিতরণের জন্য সকলেই নিজ গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইতোমধ্যে এমফিল/পি-এইচ.ডি-তে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। জোরালো মনে এমফিল গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুরু হলো বিষয় নির্ধারনের জন্য বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলীর বাসায় দৌঁড়ঝাপ। যা ছিলো গবেষণাপূর্ব গবেষণা। বিষয় নির্ধারণ হয়ে যথারীতি গবেষণা শুরু হলো। এমফিল কোর্স ওয়ার্ক পরীক্ষার গন্ডি পেরিয়ে শিক্ষকমন্ডলীর পরামর্শে পি-এইচ.ডি গবেষণায় স্থানান্তারিত। রাব্বুল আলামিনের অপার কৃপায় বিভাগীয় শিক্ষক ও অন্যান্য গবেষকদের সহযোগিতায় ২০১০ সালে আল-কুর’আন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ হতে পি-এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন জীবনের এক মহা মাইফলক।
বর্তমান বিশ্বে আধুনিকতার প্রভাবে অধিকাংশ মুসলমান যেখানে শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে না,সেখানে আল-কুর’আন জানা, বুঝা ও বুঝানোর যথাযথ জ্ঞানার্জনের মহান রাজপথে বিচরণকারী পথিক হিসেবে আমি আজ ধন্য। আমার ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন এই রাজপথেই তাদের জ্ঞানাজর্নের ঠিকানা খুঁেজ নেয়। যে রাজপথ হলো আল-কুর’আন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, যেখানে ট্রাফিকের দায়িত্বে আছেন বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী।
লেখক- প্রভাষক, চট্টগ্রাম মডেল কলেজ, নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম।