Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | সার্ভারে সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার

সার্ভারে সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার

swadesh_1567656372

নিউজ ডেক্স : রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতি চক্র চিহ্নিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হানা দেওয়ার পর টনক নড়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি)।

দুদক সর্বশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে অভিযান চালানোর একদিনের মাথায় মূল সন্দেহভাজন জয়নাল আবেদীনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পাশাপাশি নগরীর কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। এর আগে লাকী নামের এক রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসার পর নির্বাচন কমিশন থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্তে চুরি যাওয়া ল্যাপটপগুলোর হদিস মেলাতে পারেনি রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি। ওই ল্যাপটপগুলোর মধ্যে আলোচিত ‘৪৩৯১’ কোডের ল্যাপটপটিও ছিল।

এদিকে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর দুদকের অভিযানের পর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার নেপথ্যে সিন্ডিকেট’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটি তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে গ্রেপ্তার হওয়া অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখের পত্রসূত্র ১৭.০০.০০০০.০২৬.৩২.০১৪.১৯-৩৭০ মোতাবেক জয়নালের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিস।

অন্যদিকে মামলার পর উঠে এসেছে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। নির্বাচন অফিসগুলোতে নিয়মিত ভোটার করার কার্যক্রম চলে এলেও ভোটার নিবন্ধিত করার ল্যাপটপ কিংবা ডিভাইসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ছিল লেজেগোবরে। ইতিপূর্বে ভোটার নিবন্ধন কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এসব ল্যাপটপ থেকে মোছা হয়নি নিবন্ধন কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও আনুষাঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। ফলে নিলামে বিক্রি এসব ল্যাপটপের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়েছে নির্বাচন কমিশনের সফটওয়্যার।

গতকাল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের এক কর্মকর্তা এসব তথ্য দেন। মাত্র ১৮৭ টাকায় প্রত্যেকটি ল্যাপটপ বিক্রি করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে। তাদের এন্ট্রি সার্ভারে থাকলেও প্রত্যেকটি স্টেপ সঠিকভাবে পূরণ করা হয়নি। জাতীয় নিবন্ধন সনদের (এনআইডি) প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলোও সার্ভারে ইনপুট করা হয়নি।

এ বিষয়ে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এ উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম বলেন, দুদক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে আমাদের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম রোহিঙ্গাদের ভোটার জালিয়াতির বিষয়টি অনুসন্ধান করেছে। বেশ কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধানে দুদকের টিম রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতির সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমের মাধ্যমে অবহিত হয়েছি। মূলত দুদকের অনুসন্ধানের পরই নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের টনক নড়েছে। তারপরও আমাদের অনুসন্ধান কাজ চলমান থাকবে। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রধান কার্যালয়ে অচিরেই প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাচন কমিশনের আরেক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ভোটার করা একজন অফিস সহায়কের পক্ষে সম্ভব নয়। এত সংখ্যক রোহিঙ্গা ভোটার হলেও ফরমগুলো (ফরম-২) দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা জড়িত। থানায় মামলা করা হলেও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি সংযোজন করা হয়নি। এতে দুদককে পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে নির্বাচন কমিশনের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কর্মকর্তা হাসানুজ্জামানের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সাড়া মেলেনি।

কে এই জয়নাল আবেদীন : নির্বাচন কমিশন, দুদক ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার নেপথ্যের প্রধান কারিগর আটক জয়নাল আবেদীনের এক মামা নির্বাচন কমিশনের উচ্চ পদে পদায়িত ছিলেন। ২০০৪ সালের দেড় কোটি ভুয়া ভোটার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কারণে পরে ওই কর্মকর্তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। ওএসডি থাকাকালীন তিনি অবসরে যান।

ওই কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনে পদায়িত থাকাকালীন নিজের ভাগ্নে জয়নালকে নির্বাচন অফিসে পিয়নের চাকরি দেন। একইভাবে ১৬ জন নিকটাত্মীয়কে নির্বাচন কমিশনে চাকরি দেন এই কর্মকর্তা। যারা গ্রেপ্তার হওয়া জয়নাল আবেদীনের আত্মীয়।

চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে দায়িত্ব পালনকালে অফিসে তার আচরণও ছিল উগ্র। যে কারণে বেশ কয়েকবার শাস্তিমূলক বিভিন্ন জেলায় বদলিও হন। তবে প্রত্যেকবারই উচ্চ তদবিরে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। নিজের মামা নির্বাচন কমিশনের বড় কর্তা হওয়ার কারণে জয়নাল অফিসের বড় কর্মকর্তাদেরও মানতেন না। এতে অফিসের অন্য কর্মকর্তারাও তাকে এড়িয়ে চলতেন। সর্বশেষ তাকে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের থানচিতে বদলি করা হলেও তিনি পুনরায় নগরীর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসে বদলি হয়ে চলে আসেন।

এদিকে, আটক হওয়ার পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানান, ২০০৪ সালে তিনি অফিস সহায়ক হিসেবে নির্বাচন কমিশনে চাকরি পান। ২০০৮ সালে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রকল্প শুরু হলে তিনি কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজ রপ্ত করেন। একইভাবে কিভাবে সার্ভারে ঢুকতে হয়, কিভাবে ডাটা এন্ট্রি করতে হয়, কিভাবে তথ্য পরিবর্তন করতে হয়, সবই শিখে নেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, জয়নাল নগরীর সাবএরিয়া এলাকার যে বাসায় থাকত, সেখানে মিনি সার্ভার স্টেশন বানিয়ে রাখে জয়নাল। বাসায় বসে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে তাকে তার স্ত্রী ছাড়াও সৈকত বড়ুয়া, শাহজামাল, পাভেল বড়ুয়া, বয়ান উদ্দিন নামের চারজন সহযোগিতা করত।

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসত জয়নালের আরেক সহযোগী জাফর। এর আগে নজিবুল আমিন নামের এক দালাল রোহিঙ্গাদের সাথে ৮০-৯০ হাজার টাকায় রোহিঙ্গাদের সাথে ভোটার হওয়ার চুক্তি করত। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ভোটার হতে রাজি হত তাদের প্রথমে কঙবাজার নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মোজাফফরের কাছে নিয়ে যেত। মোজাফফর এসব রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামে জয়নালের কাছে পাঠাত।

এদিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জয়নালের ব্যবহৃত মানিব্যাগে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার ফোন নম্বরসহ কিছু কাগজপত্র পেয়েছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া বাঁশখালীর গ্রামের বাড়িতে জয়নাল তিনতলা বাড়িও নির্মাণ করছেন। -দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!