ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | বছরজুড়ে আলোচনায় চট্টগ্রাম কারাগার

বছরজুড়ে আলোচনায় চট্টগ্রাম কারাগার

নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার নানা ঘটনার কারণে বছরজুড়ে ছিল আলোচনায়। গত বছরের এপ্রিল থেকে করোনা সংক্রমণ এড়াতে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে স্বজনের সাক্ষাৎ বন্ধ রয়েছে। তবে বন্দিদের কারা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ভেতর থেকে স্বজনদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সুযোগ রয়েছে।  

বছরজুড়ে এই অঙ্গনে আলোচিত ছিল- কারাবন্দি পালিয়ে যাওয়া, চট্টগ্রাম জেল সুপার ও ডেপুটি জেলার প্রত্যাহার, সংরক্ষিত চট্টগ্রাম কারাগার অরক্ষিত হয়ে ওঠা, অনিয়মই, কারাগারে বন্দি নির্যাতনের অভিযোগে মামলা ও কারাবন্দিদের মোবাইল সেবা।

কারাবন্দির পলায়ন

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ৬ মার্চ ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে ফরহাদ হোসেন রুবেল নামে এক হাজতি পালিয়ে যায়। সদরঘাট থানার হত্যা মামলায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান তিনি। থাকতেন কারাগারের ১৫ নম্বর কর্ণফুলী ভবনের পানিশমেন্ট ওয়ার্ডে। কারা অভ্যন্তরে দক্ষিণ পাশে সীমানায় থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে রুবেলকে শনাক্ত করা হয়। একইদিন বিকেলে কোতোয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান। রাতে জেলার মো. রফিকুল ইসলাম বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।  

হাজতি পালিয়ে হওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ঘটনার পরদিন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন কারা মহাপরিদর্শক। গত ৮ মার্চ কারা কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত দলের প্রধান খুলনা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক ছগির মিয়া ডিআইজি প্রিজন চট্টগ্রামের কার্যালয়ে যান। গত ৯ মার্চ পালিয়ে যাওয়া রুবেলকে নরসিংদীর জেলার রায়পুরা থানার বাল্লাকান্দি চর এলাকা থেকে কোতোয়ালী থানা পুলিশের একটি টিম গ্রেফতার করে।  

কারাগারের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বের হওয়া কয়েদি রুবেল ট্রেনে নরসিংদী পালিয়ে গিয়েছিল। রুবেল প্রথমে কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের নিচে নামেন। সেখানে একটি পানির হাউসে চোখে ও মুখে পানি দেন। এরপর ডান পাশের গেইট দিয়ে বেরিয়ে আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ গজ দূরে নির্মাণাধীন একটি ভবনের ৪ তলায় উঠেন। গত ১৮ মার্চ রুবেলের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এ ঘটনায় কারাগারের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।  

জেল সুপার ও ডেপুটি জেলার প্রত্যাহার

হাজতি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় গত ৭ মার্চ কেন্দ্রীয় উপ মহা-কারাপরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পৃথক আদেশে চট্টগ্রামের জেলার মো. রফিকুল ইসলাম ও ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ আবু সাদ্দাতকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এছাড়া কারারক্ষী নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কারারক্ষী ইউনুস মিয়াকে প্রত্যাহার করা হয়ে। সহকারী প্রধান কারারক্ষী কামাল হায়দারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।  

গত ২৩ মার্চ কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন স্বাক্ষরিত আদেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নতুন জেলার হিসেবে পদায়ন করা হয় মুন্সিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলামকে। একই আদেশে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বন্দি পালানোর ঘটনায় বদলিকৃত (কারা অধিদফতরে সংযুক্ত) চট্টগ্রামের সাবেক জেলার মো. রফিকুল ইসলামকে কারা অধিদফতর থেকে ঝিনাইদহ জেলা কারাগারে বদলি করা হয়। গত ২৩ ডিসেম্বর কারাগারে রুবেল পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে শাস্তি হিসেবে ‘তিরস্কার’ করা হয়।  

রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের (শৃঙ্খলা-১ শাখা) সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বন্দি লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার পরও বন্দি নিখোঁজ রয়েছে মর্মে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত প্রতিবেদন প্রেরণ করে সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান প্রতারণা করেছেন। মো. শফিকুল ইসলাম খানের দায়িত্ব পালনকালে রুবেল কারাগার থেকে পালানোর ঘটনায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী ‘অসদচারণের’ অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা (নম্বর ০৮/২০২১) দায়ের করা হয়। শফিকুল ইসলাম কারাবিধির ৭১, ৭১ (১), ৭৩, ৭৮, ৮৩ ধারার বিধান অনুযায়ী কারাগারের জেলারের কাজ এবং অধস্তনদের দায়িত্ব-কর্তব্য তদারকি ও বন্দি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নিজ দায়িত্বের প্রতি উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

সংরক্ষিত কারাগার ‘অরক্ষিত’

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের দক্ষিণ ও পূর্বদিকের বিশাল এলাকা এখনও অরক্ষিত। সীমানা প্রাচীরে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও তা ডিঙিয়ে পার হওয়া যায় অনায়াসে। সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে লাগানো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন ভিড় থাকে সাধারণ মানুষের। সেখানে রাখা হয়েছে মালামাল, গড়ে উঠেছে অবৈধ পার্কিং। বন্দিদের রাখার জন্য তিনশ’ শয্যার পাঁচ তলা বিশিষ্ট যমুনা ভবনের পেছন দিকে কারাগারের বড় সীমানা প্রাচীর রয়েছে। প্রাচীরের ওপারে থাকা সড়কটি জেল রোড হিসেবে পরিচিত। সড়কের নিচ থেকে বন্দিদের নাম ধরে ডাকা হলে কিছু সময় পর সেই জানালার কাছে হাজির হয় ওই বন্দি। পরে ইশারা ও চিৎকার করে চলে কথা-বার্তা।  

১৬.৮৭ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮৫৩ জন। কিন্তু বন্দি থাকেন গড়ে ৯ হাজার। ১৯৯৮ সালে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, হালদা ও সাঙ্গু নামে পাঁচতলা বিশিষ্ট ছয়টি বন্দি ভবন ও একটি দ্বিতল সেল ভবন নির্মাণ করে সরকার। এখন ৪২টি সেল থাকলেও ধারণক্ষমতার বেশি বন্দি থাকায় পৌনে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ নম্বর সেলটি ৬৪ নম্বর সেলে রূপান্তর করা হচ্ছে বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে। ২০১১ সালে কারাগারে ঘনিষ্ট দুই কয়েদিকে আলাদা করে দেওয়ার ঘটনায় টয়লেটের ভেন্টিলেটর থেকে লাফিয়ে পড়ার হুমকি দেয় তারা। ২০১২ ও ২০১৫ সালে কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টাকালে দুজন ধরা পড়েন।

জানা যায়, কারাগারের একাধিক কর্মকর্তা ও কারারক্ষী মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে দর্শণার্থী নিয়ে বাণিজ্য, বন্দিদের নির্যাতন করে অর্থ আদায়, বন্দিদের মোবাইল ব্যবহার করতে দেওয়া ও ক্যান্টিনের খাবার সরবরাহে নানান অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কারাগারকে অনিয়মের আখড়া বানিয়ে কারা কর্মকর্তারা গড়ছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে ধরাও পড়েছেন ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি কারাগার পরিদর্শন শেষে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়মের তথ্যও পেয়েছেন। কারা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন খাতে মাসে অবৈধ আয় ৪০ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন দুদকের এক পরিচালক।

কারাভোগ করে আসা ব্যক্তিদের ভাষ্য, এখানকার ডাল হচ্ছে হালকা হলুদ রঙের পানি। মোটা চালের শক্ত ভাতের সঙ্গে মেলে পচা সবজি, মাংসের ছোট হাড় ও ছোট একটি টুকরো মাছ। ক্যানটিনে নেওয়া হয় বাড়তি দাম। নতুন আসামি কারাগারে যাওয়ার পর প্রথমে ‘আমদানি ওয়ার্ডে’ রাখা হয়। পরদিন সকালে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয় তাদের। সেখানে চলে টাকার খেলা। প্রভাবশালী বন্দিরা তাদের নিয়ে কেনা-বেচা করে। কারাগারের সাক্ষাৎ কক্ষের লোহার জালি বেশ ঘন হওয়ায় কেউ কারও কথা শুনতে পারে না। তাই টাকা দিলে কারাগারের অফিস কক্ষে বিশেষ ব্যবস্থায় সাক্ষাতের সুযোগ মেলে।

বন্দি নির্যাতন

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রূপম কান্তি নাথ নামে এক বন্দিকে বৈদ্যুতিক শক ও বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে নির্যাতনের অভিযোগে গত ৪ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার, জেলার, কারা হাসপাতালের চিকিৎসক ও রতন ভট্টাচার্য নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমানের আদালতে মামলাটি করেন নগরের পাহাড়তলীর বাসিন্দা ঝর্ণা রানী দেবনাথ। আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।  

একই আদালতে গত ১৩ ডিসেম্বর মো.শামীম নামের এক বন্দীকে নির্যাতনের অভিযোগে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম, জেলার দেওয়ান তারিকুল ইসলাম, ডেপুটি জেলার মো. সাইমুর, আইজি প্রিজনের গোয়েন্দা কারারক্ষী সবুজ দাশ ও সুবেদার মো. এমদাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে তদন্তের আদেশ দেন।

কারাগারে মোবাইল সেবা

কারাবন্দিদের জন্য প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে মোবাইল সেবা। কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বন্দিরা সরকারি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। সারাদেশে কারাগারে এই ব্যবস্থাটি চালু করা হয়। মোবাইল সেবার মাধ্যমে বন্দিদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হচ্ছে বলে জানান কারা কর্মকর্তারা।  

জানা যায়, প্রতি মিনিটে এক টাকা হারে বন্দিদের চার্জ দিতে হবে। একেকজন বন্দি প্রতি ১৫ দিনে একবার ১০ মিনিট করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। এক্ষেত্রে আগেই পরিবারের ঘনিষ্ঠ দুইজন সদস্যের মোবাইল নম্বর কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকাভুক্ত করে রাখতে হয়। সেই দুইটি নির্দিষ্ট নম্বরেই তারা কথা বলতে পারছেন। -বাংলানিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!