Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু

কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং শুরু

024442

নিউজ ডেক্স : কর্ণফুলী নদীতে শুরু হয়েছে বহুল প্রত্যাশার ক্যাপিটাল ড্রেজিং। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছাড়াই বাংলাদেশ নৌবাহিনী গত সপ্তাহ থেকে পুরোদমে এই ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর কাজ শুরু করেছে। ‘সদরঘাট থেকে বাকলিয়া চর পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪২ কোটি টাকা। শুরুতে বাকলিয়া এলাকায় নদী খননের কাজ চলছে। সেখান থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করে তা দিয়ে হামিদচরে বন্দর কর্তৃপক্ষের জায়গা ভরাট করা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, কর্ণফুলী নদী হচ্ছে দেশের অর্থনীতির প্রাণ। চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নির্ভরশীল দেশের কোটি কোটি টাকার আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য। এ বন্দর চ্যানেলই দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত। জোয়ার ভাটায় সমৃদ্ধ এই নদী প্রতিদিনই নাব্যতা হারাচ্ছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পলি জমে নদীর বিস্তৃত এলাকা ক্রমে ভরাট হয়ে উঠছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কর্ণফুলীতে এত বেশি পলি জমছে যে, কোথাও একটি খুঁটি পুতে রাখলে কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে বালির বিরাট আস্তরণ তৈরি হচ্ছে। তাই নিয়মিত ড্রেজিং না করলে কর্ণফুলী নদী কিংবা বন্দর চ্যানেলকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এছাড়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ারও আশংকা প্রকাশ করেন বন্দর কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভরাট হয়ে যাওয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে কর্ণফুলীতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়। নিজস্ব জাহাজ দিয়ে প্রতিদিন নদীর কোনো কোনো অংশে ড্রেজিং চালায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে মোহনা থেকে নিচের দিকে নিয়মিত চলে এই ড্রেজিং কার্যক্রম। তবে এই ধরনের ড্রেজিং দিয়ে ভরাটের তীব্রতা পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হয় না। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বছর কয়েকের ব্যবধানে বড় আকারে ড্রেজিং কার্যক্রম চালাতে হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য মতে, আশির দশকের শুরুতে নেদারল্যান্ডের একটি কোম্পানি চট্টগ্রাম বন্দরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে। ১০ বছরের ব্যবধানে ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে আবারো ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হয়। চায়না হারবার কোম্পানি এই ড্রেজিং করেছিল। এরপর ২০০০ সালে পুনরায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ফাইলের পর ফাইল চালাচালি হলেও এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নানা প্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৫ জুলাই কর্ণফুলী নদীতে ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ব্যাংক প্রটেকশন’ নামে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২২৯ কোটি ৫৪ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬ টাকা সর্বনিম্ন দর দিয়ে প্রকল্পটির কাজ পায়। এই প্রকল্পে ড্রেজিং ছাড়াও ২ হাজার ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের তীর নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভ তৈরি ও সদরঘাট এলাকায় ৪০০ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণের কথা ছিল। ড্রেজিং শেষ হলে সংশ্ল্লিষ্ট নদী এলাকায় গভীরতা চার মিটার ও নদীর সঙ্গে যুক্ত (মূল দুই খাল) রাজখালী ও চাক্তাইয়ের সম্মুখভাগে গভীরতা আরো বাড়ার কথা ছিল। অন্যদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরুর ৬০০ দিন অর্থাৎ ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে মালয়েশিয়ান কোম্পানিটি স্থানীয় প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসেস নামের একটি কোম্পানিকে নিজেদের কাজে নিয়োগ দেয়। আর তখন থেকেই নানা অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠতে থাকে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর নামে কর্ণফুলীর মাটি বিক্রি করে দেয়া, মাটি দিয়ে ইট বানানো, নদীর বিস্তৃত এলাকা ভরাট করে দেয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যায় যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসেস। বন্দর কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় পত্র দিলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কিংবা তাদের স্থানীয় এজেন্ট কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। এই অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চুক্তি বাতিল করে। চুক্তি বাতিলের চিঠি নিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়।

পরবর্তীতে নানা আইনি ধাপ পেরিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রক্রিয়া শুরু করে। তবে ভবিষ্যতের আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষ বন্দর ক্যাপিটাল ড্রেজিং নাম ব্যবহার না করে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ প্রকল্প নামে নতুন করে প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু করে। প্রকল্পের ব্যাপারে বুয়েট থেকে সার্ভে করানো হয়। বুয়েটের সমীক্ষা রিপোর্টের উদ্বৃতি দিয়ে বন্দরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করতে হবে। এখানে বেশ কিছু চরের সৃষ্টি হয়েছে। এসব চর থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি তুলতে হবে। প্রতি ঘনমিটার মাটি উত্তোলনে খরচ হবে ৩৭৩ টাকা। আর পুরো প্রকল্প সম্পন্ন করতে খরচ হবে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা। শুধু ড্রেজিংই নয়; পরবর্তী তিন বছর নদী রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে বলেও রিপোর্টে উল্ল্লেখ করা হয়।

ইতোপূর্বে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় ৩৬ লক্ষ ঘনমিটার মাটি ও বালু উত্তোলনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। দীর্ঘদিন ধরে এই ড্রেজিং প্রকল্প বন্ধ থাকায় পূর্বেকার ড্রেজিং করা অংশও ভরাট হয়ে যায়। এছাড়া বাকলিয়াতে বিশাল এলাকা জুড়ে চর সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বন্দরের সদরঘাট এলাকার জেটিসমূহের সম্মুখ ভাগ পলি জমার ফলে ব্যাপক হারে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। একইসাথে বর্ষাকালে কর্ণফুলী নদীর উপচেপড়া পানি নগরীতে সয়লাব হয়ে যায়। এজন্য বর্তমান ড্রেজিং কার্যক্রমের আওতায় ৪২ লক্ষ ঘনমিটার বালি ও মাটি উত্তোলনের কথা বলা হয়। উক্ত বালি ও মাটি বন্দরের হামিদচর এলাকা ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হবে বলে জানানো হয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ বলেন, আমরা নদী খননের কাজ শুরু করেছি। ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর মতো করে আমরা নদী থেকে মাটি ও বালি উত্তোলন করব। শুরুতে আমরা বাকলিয়া এলাকায় কাজ শুরু করেছি। সদরঘাট এলাকায় আমাদের যে লাইটারেজ জেটিগুলো নির্মাণ করা হয়েছে দু-চারদিনের মধ্যে সেগুলোর সামনের অংশে ড্রেজিং করা হবে। আমরা সেখানে পরিষ্কার করে জাহাজ ভিড়ানোর ব্যবস্থা করব। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্দরের নাব্যতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলেও বন্দর চেয়ারম্যান আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সূত্র : দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!