মোঃ জামাল উদ্দিন : চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলা। এখানে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ সংস্কারক জন্মগ্রহণ করেছেন। যাঁদের আলোকিত জীবন পরশে অন্ধকার দূর হয়ে গেছে। মাওলানা আশরফ আলী (রাঃ) তাঁদের অন্যতম। দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করেও এ মনিষী গোরামীর পথে পা বাড়াননি। তাঁর পরশ ও সান্নিধ্য পেয়ে অনেকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। মসজিদে মুসল্লীদেরকে সত্যের পথে আহবান জানাতেন। তিনি ১৯৫১ সালে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর প্রতিষ্টিত আধুনগর আখতানিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও শাহ জব্বারিয়া এতিমখানা গরীব-দুঃখী ও এতিমদের সাহসী ঠিকানা। প্রতিদিন এসব প্রতিষ্ঠান অগণিত শিক্ষার্থীদেরকে আলোর পথে, সত্যের পথে ডাক দিয়ে যায়। দিয়ে যাচ্ছে। বেহেস্তী রহমতের আবরণে ঢাকা এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত রহমতের ফুল ঝরে পড়ে। এ মনিষী প্রতিষ্ঠান সন্নিহিত কবরস্থানে শায়িত থেকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকেন। প্রতিষ্ঠান সমূহ দেখতে ও হুজুরের অধ্যাত্মিক সান্নিধ্য পেতে আপনাকে বেগ পেতে হবে না। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের লোহারদিঘী পাড়ে নেমে সামান্য পশ্চিম দিকে গেলেই আপনি তাঁর অবস্থান দেখতে পাবেন। তাঁর জীবনের গল্প অত্যন্ত চমৎকার। দরিদ্র মানুষকে অকাতরে সাহায্য করতেন। দারিদ্রতা জয় করার জন্য মানুষকে শিক্ষা ও কর্মের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। তাঁর জন্মস্থান আধুনগর ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি এলাকা। কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, অনাচারে ভরপুর ছিল এলাকাটি। স্বল্প আয়ের মানুষ ছিলেন তিনি, তদবীর ও অর্থের জোর ছিলনা, ছিল শুধু মেধা, অধ্যবসায়, আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং নিজ পীরের দোয়া। অনেকে তাকে পাগল বলত, কিন্তু তিনি দমেননি, তাই তিনি সফল হয়েছেন।
সমাজের মধ্যে তিনি ঐক্যে, শান্তি ও সংহতি কামনা করতেন। এই জন্য যে কোন সামাজিক সমস্যা সমাধানে তিনি দ্রুত এগিয়ে যেতেন। যে কোন অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, অপসংস্কৃতির উদ্ভব হলে তিনি সংগঠিতভাবে প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়তেন। তিনি ভাল বক্তা ও লেখক ছিরৈন। তার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জিকির মাহফিল পরিচালনা করতেন। তাঁর মুনাজাত মানুষকে আকর্ষণ করত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চকরিয়া বায়তুশ শরফ মসজিদের খতিব ছিলেন। তাঁর বক্তব্য শুনার জন্য তখন অনেক লোকের সমাগম হত। রমজান মাসে ফজরের নামাজের আগে তিনি সবাইকে নিয়ে জিকির করতেন। এই জিকির পুরো এলাকাবাসীকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করত। আধুনগরের একটি পাড়ার নাম ছিল খয়রাতি পাড়া। নামটা কারো সামনে উচ্চারণ করতেও অনেকের খারাপ লাগত। ব্যাপারটা মৌলানা আশরফ আলী (রাঃ) কে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না। তাঁর স্বপ্ন ছিল বায়তুশ এর প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম শাহসূফী আলহাজ্ব মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর ছাহেব (রাহঃ) এর নামে পাড়ার নাম দেওয়া। এর জন্য তিনি পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে লাগলেন। এক সময় সফল হলেন। আজ খয়রাতি পাড়ার কথা মানুষ ভুলে গেছে। এখন পাড়ার নাম আখতারিয়া পাড়া। পাড়ার নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে সবখানে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, চিন্তা চেতনা ও মূল্যবোধ এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
আখতারিয়া পাড়ার মানুষগুলি বায়তুশ শরফ এর পীর সাহেবের মুরিদ। তারা অধীর অপেক্ষায় থাকত বায়তুশ শরফের পীর সাহেবের সাথে একটু দেখা করার জন্য। এলাকার মানুষের এই আশা-আকাংখাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন মাওলানা আশরফ আলী (রাহঃ)। তিনি মাদ্রাসার সভা করে সেখানে নিয়ে গেছেন, বায়তুশ শরফের মরহুম হুজুর কেবলা (রাহঃ) ও বর্তমানে বাহরুল উলুম শাহসূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (ম.জি.আ.) ছাহেবকে। মাওলানা আশরফ আলী (রাহঃ) ছিলেরন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। মাদ্রাসার পাশাপাশি কলেজেও পড়েছেন তিনি। আনসার বাহিনীর ট্রেনিং নেন তিনি। চিকিৎসা বিষয়েও তাঁর পড়াশোনা ছিল। ভূমি পরিমাপের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান ছিল। বিজ্ঞান বিষয়েও তাঁর পড়াশোনা ছিল। বিচার-শালিসে তিনি দক্ষ ছিলেন। লেখালেখিতেও ছিলন পারদর্শী। তিনি ভাল বয়ান করতেন। এলাকার উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। লোভ-লালসা তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কোন কাজ তিনি সহ্য করতেন না। সত্য যতই অপ্রিয় হোক, তা তিনি বলতে দ্বিধা করতেন না। সত্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন।
“মানুষ মানুষের জন্যে” এ বোধে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তিনি আজীবন গোরামীর উর্ধ্বে থেকেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ছিরদিন মানুষ অনুসরণ করবে এমনটাই এলাকাবাসীরা অভিমত রেখেছেন। কৃতজ্ঞতা স্বীকারে- শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন, আধুনগর।