- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

সাতকানিয়ায় ভিক্ষার জমানো ৬০ হাজার টাকা মসজিদে দান করল ভিক্ষুক

নিউজ ডেক্স : দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কোন দূর্যোগ কিংবা দেশের কোনো ক্রান্তিকালে দান করেছেন তাতে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে দানবীর। এমনও শুনা যায় কোনো এলাকার জনৈক ব্যক্তি গরীব দুঃখি দুস্থমানুষের পাশে থেকে সর্বদা দান করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ দানবীরের বদান্যতা ঘটা করে ছাপা হচ্ছে অথবা প্রচারিত হচ্ছে।

ভিক্ষাভিত্তির টাকা জমিয়ে জনহিতকর ও ধর্মীয় কাজে ব্যয় করার মতো নজির পৃথিবীতে বিরল। এমনিই হয়েছে সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়ন এলাকায়।

নাম আবদুল মোতালেব। বয়স আনুমানিক পৌঁনে শতকের কাছাকাছি। পেশায় একজন ভিক্ষুক। ভিক্ষাভিত্তিতেই চলে যার জীবন জীবিকা।

বয়োঃসন্ধিকাল থেকে ভিক্ষাভিত্তি দিয়েই জীবনের এতটুকু পাড় করেছেন। ওপাড়ে যাওয়ার সময় হয়ত আর বেশি বাকী নেই। বৃদ্ধ আবদুল মোতালেবের শারীরিক অবস্থা আর ভারসাম্যহীনতা দেখে যে কেউ সেটাই উপলব্দি করবে।

মোতালেবের আদি ঠিকানা বাঁশখালী উপজেলায়। আজ থেকে প্রায় শতবছর আগে তার পিতা জীবিকার তাড়নায় সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া ইউনিয়নের গীলাতলী বাকর আলী বিল এলাকায় আসেন।

শুরুতেই মোতালেবের পিতা সৈয়দ আহমদ ওই এলাকায় গৃহ শিক্ষক (লজিং মাষ্টার) হিসেবে নিজের পরিচিতির গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে এ এলাকায় পিতা সৈয়দ আহমদ সংসার পাতেন আর ধীরে ধীরে স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত হন।

পিতার সংসারের একমাত্র বংশধর আবদুল মোতালেব। এরইমধ্যে মোতালেবের মাতৃ বিয়োগে পিতা সৈয়দ আহমদ দ্বিতীয় সংসার শুরু করলে শিশু আবদুল মোতালেবের উপর নেমে আসে সৎ মায়ের স্টিম রোলার। অন্যদিকে শিশু মোতালেবকে ভর্তি করানো হয় সরকারি বিদ্যালয়ে।

শিক্ষা অর্জন যতটুকুই হোক না কেন বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা নিয়মিত চলতে থাকে শিশু মোতালেবের। তখনও মোতালেব গন্ডিবাধা জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেনি। একদিকে সৎ মায়ের অত্যাচার অন্যদিকে বিদ্যালয়ের বাধাধরা নিয়ম কোনটাই মেনে নিতে পারেনি মোতালেব।

জীবন ভাসানো আর জীবন সাজানো নিয়ে যখন মোতালেব দোদূল্যমান পরিস্থিতিতে ঠিক তখনই সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে পরাপারে পাড়ি জমালেন পিতা সৈয়দ আহমদ। যারফলে মোতালেবের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাইমারি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ। এ কঠিন পরিস্থিতিতে চোখে সর্ষে ফুল আর অমানিশার অন্ধকার নিয়েই শিশু মোতালেবের ভবঘুরে জীবনের সূচনা। সেই থেকে অদ্যাবধি চলতে থাকে ভিক্ষাভিত্তি। আজ মোতালেব অনেকটা জীবন সায়ান্নে। হয়ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ ভিক্ষাভিত্তিতেই স্থিত থাকবেন মোতালেব।

সেকাল থেকে ভিক্ষার টাকায় নিজে দু’বেলা খেয়ে অবশিষ্ট টাকা সঞ্চয় করতেন। সেই জমানো টাকা দিয়ে এলাকার মানুষকে খাওয়াতেন আর বিভিন্ন মসজিদে দান করতেন।

ভিক্ষুকেরও উচ্চ বিলাস থাকে কিন্তু মোতালেব যে কোন ধরনের বিলাসীতার স্বপ্ন দেখেননি তা’ সহজেই অনুমেয়। জমানো টাকা অকাতরে দান করলেও তার কোনো ভিটে বাড়িঘর বলতে কিছু নেই।

ঘর ছাড়া এ ভবঘুরে মোতালেব সুখের আশায় এক সময় ঘরনী নিয়ে সংসারও করেছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বছর দু’য়েক সংসার চললেও বংশ বিস্তারের আগেই পরকীয়ার টানে স্ত্রী চলে যায় অন্যজনের হাত ধরে। তখন থেকে আর সংসার নিয়ে কোন চিন্তা করেননি বলে জানান বৃদ্ধ মোতালেব।   

নিঃসঙ্গ এ বৃদ্ধ মোতালেবের পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা থাকলেও মুখে হাসি লেগেই থাকে। সারাক্ষণ মুখের হাসি তাঁর ফুরায় না। ভিক্ষা পাওয়া না পাওয়া বিষয় নয় হাসি কিন্তু মুখে লেগেই থাকে এটাই তার বৈশিষ্ট।

জীবন সন্ধিক্ষনে এসেও বৃদ্ধ মোতালেবের ধর্মীয় অনুভুতি প্রখর। এটা বুঝা যায় যখন রাতে বিস্কুট খেয়ে প্রায় সময় রোজা পালন করেন।

জানা যায়, ভিক্ষার জমানো টাকা দিয়ে এলাকবাসীকে গরু জবাই করে মোতালেব মেজবানও খাওয়েছিলেন। সর্বশেষ আবদুল মোতালেবের বদান্যতার প্রমান মিলে জীবনের শেষ সম্বল হিসেবে গচ্ছিত অর্থ যখন এক মসজিদে দিয়ে দেন। জানা গেছে মোতালেবের জীবনের জমানো ৬০ হাজার টাকা বাজালিয়া কেন্দ্রিয় জামে মসজিদে (পোক্তা মসজিদ) মুক্তহস্তে দান করে দিয়েছেন।   

দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব শুরু হলে ভিক্ষুক আবদুল মোতালেব বার্ধক্য জনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ মোতালেবকে রাতের অন্ধকারে কে বা কারা পোক্তা মসজিদের নীচে ফেলে চলে যান। তারপর থেকে এলাকার ফরিদ সিকদার নামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির উৎসাহে বাজালিয়া এলাকার দুই বন্ধু বান্দরবান জেলা হাসপাতালের সহকারি সার্জন ডা. রায়হান ছিদ্দিকী ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি রকিম উদ্দিন রকিব মিলে অসুস্থ মোতালেবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ধারনা করা হচ্ছে বাকর আলী বিল এলাকায় এক সময় যারা তাকে টিনের ঝুপড়ির মত মাথা গুজার ঠাই করে দিয়েছিল পোক্তা মসজিদে সব টাকা দান করে দেয়ায় তারা হয়ত ক্ষুদ্ধ হয়ে মোতালেবকে এখানে রেখে গিয়েছে। অবশেষে বাজালিয়া জামে মসজিদের নীচ তলায় একটি কক্ষে বৃদ্ধ মোতালেবের থাকার স্থান হয়। বর্তমানে মসজিদের খাদেম আবুকে লোকটার দেখাশুনার দায়িত্ব নেয়ার কথা বললে তিনি সাদরে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এদিকে মোতালেবের চিকিৎসা ও খাদ্যসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের অর্থ প্রদানের ঘোষণা দেন ফরিদ সিদকার। ডা. রায়হান ছিদ্দিকী ও রকিম উদ্দিন রকিব এর নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন। অপরদিকে খাদেম আবু নিজের পরিবারের সদস্যের মত বাড়ি থেকে দুবেলা খাবার নিয়ে আসেন।

বর্তমানে বৃদ্ধ মোতালেবের সমাদরের যেন কোনো কমতি নেই। একদিকে খাদেম আবু, অপরদিকে ডা. রায়হান ছিদ্দিকী ও রকিম উদ্দিন রকিব তারা দু’বন্ধু নিয়মিত দেখভাল আর পরিচর্যায় সুস্থতা ফিরে পেয়েছেন বৃদ্ধ মোতালেব। তাছাড়া এলাকার ধনাঢ্য ফরিদ সিকদারতো আছেনই।

যোগাযোগ করা হলে ডা. রায়হান ছিদ্দিকী ও রকিম উদ্দিন রকিব বলেন, মোতালেব সম্পর্কে আসলে আমরা কিছুৃ জানতাম না। এলাকার মুরব্বি ফরিদ সিকদার আমাদেরকে এ কাজে অনুপ্রানিত করেছেন। তার অনুপ্রেরনাতেই আমরা দু’বন্ধু এ মানবিক সেবায় আত্মনিয়োগ করেছি। সিভয়েস