- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

সবজি বিক্রেতা থেকে উপ-পরিচালক

1505707574
নিউজ ডেক্স : দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে জন্ম তার। পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতা তেমন ছিল না। তাই পরিবারের প্রয়োজনে বাজারে বিক্রি করেছেন নিজেদের উৎপাদিত সবজি, লাউ, গরুর দুধ। পড়ালেখার পাশাপাশি করতে হয়েছে কৃষিকাজও। কখনো করতে হতো লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ, ধান রোপন কিংবা জুম চাষ। গ্রামের সবজি বিক্রেতা সেই ছেলেটি একদিন বাংলাদেশ সরকারের বড় কর্মকর্তা হবে, সরকারের একটি অধিদপ্তরের উপ পরিচালক হবেন হয়তো তা কেউ ভাবতেই পারেনি। বলছিলাম বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উপ অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমার কথা।
মুকুল জ্যোতি চাকমার জন্ম রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম বঙ্গলটুলি গ্রামে। পরিবারে পাঁচ সন্তানের মাঝে একমাত্র ছেলে সন্তান তিনি। তার পরিবার আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল ছিল না। বাবা তুষার কান্তি চাকমা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তবু পাঁচ ভাই-বোনের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে বাবাকে অনেক হিমশিম খেতে হতো। পরিবারের আয় বাড়াতে নিয়মিত কৃষি কাজ করতে হতো। ধান চাষ, জুম চাষ এবং বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ করতে হতো। নিজেদের উত্পাদিত কৃষি পণ্য স্থানীয় বঙ্গটুলি বাজারে বিক্রি করার দায়িত্ব পড়ত মুকুলের উপর।
মুকুল জ্যোতির শিক্ষাজীবন শুরু বঙ্গলটুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে তাকে পাড়ি দিতে হতো চার কিলোমিটার পাহাড়ি দুর্গম পথ।
রুপালি উচ্চবিদ্যালয়ে তার মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন কাটে। উচ্চবিদ্যালয়ে যেতে তার পাড়ি দিতে হতো দুর্গম নয় কিলোমিটার পথ। দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে নৌকায় পাড়ি দিতে হতো কাচালং নদী। কৈশোরে মুকুলের পড়ালেখার তেমন সুখস্মৃতি নেই। গ্রামে বিদ্যুত্ ছিল না। রাতে কুপি জ্বালিয়ে পড়তে হতো। অনেক সময় কেরাসিন না থাকায় পড়া সম্ভব হতো না। মাধ্যমিক পড়া শেষে বাবার ইচ্ছা ছেলে পলিটেকনিকে পড়ুক। মুকুল জ্যোতির আগ্রহ কলেজে পড়ার। ভর্তি হলেন রাঙামাটি সরকারি কলেজে।
মুকুল জ্যোতি বলেন, ‘গ্রাম থেকে এসেছি বলে জেলা সদরের কলেজ ছাত্ররা তেমন পাত্তা দিত না। আমার পোশাকেও ছিল গ্রাম্য ভাব। শহরের ছেলেদের মতো দামি পোশাক পরতে পারিনি কখনো।’
১৯৮৮ সালে রাঙামাটি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন মুকুল জ্যোতি। এবার উচ্চ শিক্ষার পালা। কিন্তু তখন পরিবার ছিল চরম আর্থিক সংকটে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে টাকার দরকার ছিল মুকুলের। এমন খারাপ সময়ে নিকট আত্মীয় ডা. স্নেহ কান্তি চাকমার আর্থিক সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানিতে পড়ার সুযোগ পেলেও আবাসিক অসুবিধার কারণে পড়া হয়নি। পরে ইতিহাস বিষয়ে পড়ার সুযোগ পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুকুল জ্যোতি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে মজার জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
আবাসিক থাকতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলে। হলের ৪৩৭নং রুমে থেকেছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দীর্ঘ পাঁচ বছর। বাবা মাসে ১২ শত টাকা পাঠাতেন, এই টাকায় পুরো মাস চালিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হতো। ডাইনিংয়ে খেতেন কম দামে। পরে ভালো রেজাল্ট করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৩০০ টাকা মাসিক শিক্ষাবৃত্তি পেতেন। তিনি ১৯৯৫ সালে মাস্টার্স পাস করেন। এবার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর পালা। কিন্তু এদিক, ওদিক অনেক চেষ্টার পরও চাকরি মেলেনি তার। শিক্ষিত বেকার হয়ে কাটিয়েছেন দুই বছর।
১৯৯৭ সালে একটি ইলেট্রনিক কোম্পানিতে মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে সেলসম্যানের চাকরি নেন। সেলসম্যানের চাকরি ছিল মাত্র আট মাস। আবার বেকার। মুকুল চিন্তা করলেন, মরি বাঁচি অনন্ত বিসিএস পরীক্ষাটা দিই। কিন্তু মাস্টার্স পাস করেও বেকার, ঢাকায় থাকা, খাওয়ার জায়গা নেই, বাবা কাছে টাকা চাইতেও লজ্জা লাগে। থাকা-খাওয়ার চুক্তিতে এক আত্মীয়ের ছেলেকে টিউশনি পড়াতে শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি নিতে থাকেন বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি। ১৯৯৯ সালে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরি পান। তার ইচ্ছা সরকারের বড় জায়গায় কাজ করা, তাই চাকরির পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ২০০০ সালে পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সহকারী পরিচালক হিসেবে চাকরি পান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। ২০১২ সালে উপ পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। বর্তমানে ঢাকা মেট্রো উপ অঞ্চলে উপ পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ সফলতার সঙ্গে।
ভারত, দক্ষিন কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জার্মানে পেশাগত কোর্সে সফলতার জন্য পেয়েছেন অনেক সনদ ও সম্মাননা। পারিবারিক জীবনে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন জয়ন্তী খিসার সঙ্গে। পারিবারিক জীবনে তিনি এক মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। -ইত্তেফাক