ফিরোজা সামাদ : পরদিন থেকে সত্যি সত্যি শুভ্রতার কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। শুভ্রতার মুখের সেই ক্লোজআপ হাসি মিলিয়ে গেলো গতকাল রাতের অাঁধারীতে। বিষন্নতায় শুরু হলো দিন। মা শাহানা বেগম মেয়ের কাছে এসে সান্ত্বনা দেয়, বলে দেখ মা কয়েকদিন পর সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে। শুভ্রতা কোনো জবাব দেয়না, চুপকরে থাকে। শুধু একটা মুখচ্ছবি বার বার ওর মানসপটে ভেসে ওঠে। শুভ্রতা অাশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকে একটি চিঠি, একটি শুকনো গোলাপ ও একটি রাত কতো সহজে রক্তের অাপনজন দূরে চলে গেলো, অার যাকে শুধু একনজর দেখেছে সেই মানুষটিই মনের সবটুকু জায়গা জুড়ে বসে অাছে। সড়ানো যাচ্ছেনা কিছুতেই। কিন্তু মানুষটি হয়তো কোনোদিনই জানতেই পারবেনা যে তার একটি চিঠি শুভ্রতার জীবন কতোটা ওলোট পালোট হয়ে গেলো ?
সকালে ঘুম থেকে উঠে মারুফ ভাবতে থাকে অাজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ শুভ্রতার কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার। মনের অানন্দে রেক্সোনা সাবান গায়ে মেখে সামনের বড়ো পুকুরে ইচ্ছেমতো সাঁতার কেটে
গোসল করে নেয়। চুলগুলো ক্লিনিক প্লাস শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নেয়। তারপর লোহার ইস্ত্রিতে শার্ট প্যান্ট অায়রন করে পড়ে নেয়। কালকে জেমিনিজ ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর থেকে কিনে অানা পারফিউম স্প্রে করে রিক্সা নিয়ে সকাল ন’টার মধ্যে কলেজ গেটের সামনে কৃষ্ণচূড়ার তলায় হাতে একটি ডায়রী নিয়ে শুভ্রতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। একে একে সব ছেলেমেয়ে কলেজে অাসলেও শুভ্রতা এলোনা। অজানা এক অাশঙ্কায় মারুফের মনটা হাহাকার করে ওঠে। কি করবে ভেবে পায় না। হাত পা অবসন্ন হয়ে অাসছে। সূর্য তখন মধ্যগগনে, মারুফ গাছের সাথে হেলান দিয়ে বেলা একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে কলেজের ভেতর ঢুকে যায় । কলেজে গিয়ে ছেলেদের কমনরুমে অনেক্ষণ বসে থাকে। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে, অারে বন্ধু রনি তো শুভ্রতাকে চেনে । কয়েকদিন ওকে কথা বলতে দেখেছি। ক্লাশ শেষ হতেই রনিকে খুঁজতে থাকে। একসময় পাওয়াও যায়। ওর কাছে শুভ্রতার ঠিকানা জানতে চাইলে, রনি কৌতুহলী হয়ে….
….. কী ব্যাপার দোস্ত ? হঠাৎ শুভ্রতার
ঠিকানা ?
….. তুই অামায় বল ওরা কোথায় থাকে?
….. কারোর সম্পর্কে না জেনেই তাকে
ভালোবাসতে গেলি দোস্ত, ও অামার
অাত্মিয়া, অাগে খোঁজ নেই তারপর
তোকে জানাবো ।
….. তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো রে।
শুভ্রতাদের বাসায় ল্যান্ড ফোন থাকলেও এক্সচেঞ্জ হয়ে যেতে হয়। মারুফ চেষ্টা করেছে ফোন করতে। কিন্তু দুই তিনদিন ফোন করলেও অপরপ্রান্তে পুরুষকন্ঠ পেয়ে লাইন কেটে দেয়। অতঃপর রনির উপর ভরসাই শেষ সম্বল ভাবলো।
শুভ্রতার বাবা এনামূল হক সাহেব এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি হলেও একটু নিষ্ঠুর প্রকৃতির, কিছুটা স্বার্থপরও বটে।
বড়ো ভাই তিনটিও বাবার নৈতিকতায় বেড়ে উঠেছে। পরদিন ছেলেদের সাথে কথা বলে বাসায় ঘটক ডেকে পাঠালো।
শুভ্রতার জন্য ভালো সচ্ছল ছেলে পেতে খুব একটা কষ্ট তো হলোই না বরং দিন কয়েক অাগে প্রবাস থেকে ফেরা ডাক্তার অারিফ এই প্রস্তাব সাচ্ছন্দ্যে লুফে নিলো।
অষ্টাদশী পাড় হওয়া এক যুবতীর সাথে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো পঁয়ত্রিশোর্ধ ডাক্তার অারিফের সাথে একান্তই ঘরোয়া পরিবেশে । শুভ্রতা মুখে নয় শুধু অশ্রুজলেই মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিরব প্রতিবাদ জানালো। মাও বিনিময়ে চোখের পানি দিয়ে মেয়েকে অাশির্বাদ করলেন অার মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিতে থাকেন। ভাবেন মেয়ের এই জীবনের জন্য শুধু অামিই দায়ি অার বন্দিনী হলো শুভ্রতা সেদিন থেকে অন্য এক নিয়তির হাতে।
মারুফকে রনি অন্যকোনো খবর দিতে না পারলেও শুভ্রতার বিয়ের খবর দিয়ে দিলো। শুনে নিজেকে অার ধরে রাখতে পারলো না মারুফ। দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। রনি হতবাক, এতোটুকু ভালোবাসায় ছেলেরা এতো কষ্ট পেতে পারে ? মারুফকে বোঝাতে থাকে, কেঁদে অার কি হবে, তার চেয়ে শুভ্রতা সুখি হোক এই সান্ত্বনা বুকে নিয়ে বেশ কয়েকদিন কলেজ বন্ধ দিয়ে নিভৃতে কাটিয়ে দেয়। শুভ্রতার স্বামী অাট দশদিন শশুরবাড়ি কাটিয়ে অাবার প্রবাসে ফিরে যায় অার শশুরকে বলে গেলো দু’মাসের মধ্যই শুভ্রতাকে নিয়ে যাবে। শুভ্রতা অবাক হয়ে ভাবে নারী কতো অসহায় ! বাবা ভাই দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে স্বামী নামে যার কাছে হস্তান্তর হলো তাকেও নিরাপদ সঙ্গী মনে হলো না। শুভ্রতা এই সাতদিনে এই লোকটার সাথে শুধু হ্যাঁ না এবং ঘার মাথা নেড়ে কথা বলার মধ্যই সীমাবদ্ধ ছিলো। অারিফ ফিরে যাওয়ার অাগের রাতে শুভ্রতাই বলেছিলো ” অামি কি কলেজ যাবো ? উত্তরে অারিফ বললো কী প্রয়োজন? দুইমাস পরেই তো অামার কাছে চলে যাবে। অারিফের কন্ঠে যেনো ওর বাবার কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলো শুভ্রতা …….(চলবে)