মোঃ মাহবুব আলম : ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যারা যুদ্ধ করে শুধু তারা না, প্রচলিত অন্যায়, জুলুম কিংবা প্রথার বিরুদ্ধে যারা বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ায়, লড়ে যায়, তারাও কিন্তু যোদ্ধা। হারকিউলিস যেমন যোদ্ধা, পচাব্দী গাজী যেমন; তেমনি বেগম রোকেয়াও যোদ্ধা।
বেগম রোকেয়া হাতে অস্ত্র তুলে না নিলেও প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে একলা লড়েছিলেন। শরমিনকেও আমার যোদ্ধা মনে হয়। ওয়ান পারসন আর্মি মনে হয়।
শরমিনকে (১১) আমি চিনি গত বছরের ডিসেম্বর থেকে। ফারাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস থ্রির এক শিশু শরমিন মাধ্যম দিয়ে খবর পাঠাল, মাঝবয়সী এক পুরুষের সাথে তার বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছে। সে এই বিয়ে থেকে মুক্তি পেতে চায়। তড়িঘড়ি করে বিয়ে ঠেকালাম।
শরমিনের বাবা-মা ও বিয়ে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সকলের কাছ থেকে মুচলেকা নিই এবং সতর্ক করি যেন আইনগত বয়স না হওয়া অবধি মেয়ের বিয়ে না দেয়। শরমিনের বিয়ের জন্য কেনা কানের দুল জব্দ করে আমার জিম্মায় রাখলাম। ভবিষ্যতে তার শিক্ষাখরচ মেটাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা পোস্ট অফিসে ডিপিএস করি এবং তাকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সব ধরনের আশ্বাস প্রদান করি।
গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত। গল্পটা শেষ হয়নি ফারাঙ্গার পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিশুর বিয়ে ঠেকাতে গিয়ে। ঐ বিয়ে ঠেকানোর সময় জানলাম, কঠোর গোপনীয়তায় শরমিনের বিয়ে হয়ে যায় বান্দরবানের লামার হাছনা ভিটায় তার মামার বাড়িতে।
শরমিন এখন তার শ্বশুরবাড়ি মহেশখালীতে থাকে। জানলাম তার স্বামী পানের বরজে কাজ করে। মানবিক সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা সত্ত্বেও বিয়ে ঠেকাতে না পারায় মনটা ভেঙ্গে পড়ল। ব্যর্থতা মেনে নিতে কষ্ট হল। বাল্য বিবাহের আইনটি মোবাইল কোর্টে তফসিলভুক্ত হতে বিলম্ব হওয়ায় এই বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করতে পারলাম না।
হতাশ মনে বাল্য বিবাহ অনুৎসাহিত করার জন্য ক্যাম্পেইন শুরু করি। বিভিন্ন অংশীজনকে বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারণা চালাতে অনুরোধ করি। উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহযোগিতায় শিক্ষার আলো বঞ্চিত ও অভাবে জর্জরিত গ্রাম গুলোতে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মায়েদের বাল্য বিবাহের কুফল বলে সচেতনতা চালানো শুরু করে দিলাম। শিক্ষা অফিসও শিক্ষকদের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল অবিরত।
নানা দাপ্তরিক ব্যস্ততায় শরমিনের কথা আস্তে আস্তে ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে আচানক একটা ফোনকল ভুলতে দেয়নি শরমিনের কথা।
-হ্যালো স্যার, আমি শরমিন বলছি।
-কোন শরমিন?
– ফারাঙ্গার শরমিন স্যার। ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। যার বিয়ে আপনি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।
– তুমি কোথায় এখন, শরমিন?
– আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসছি। বাড়ি গেলে আবার আমাকে মহেশখালীতে পাঠিয়ে দিবে। স্যার আমি পড়ালেখা করতে চাই। আমাকে আপনি বাঁচান।
– তুমি কাউকে বলে আমার অফিসে চলে আস।
-স্যার গাড়িতে উঠছি কিন্তু আমার গাড়ি ভাড়া নাই।
– অসুবিধা নাই। তুমি উপজেলা গেইটে নামো। কাউকে দিয়ে তোমার ভাড়া পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর শরমিন অফিসে আসলো। দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করে বলল, সে পড়তে চায়। সে আশ্রয় চায়। বর্তমানে সে প্রশাসনের জিম্মায় আছে। দুদিন পর তাকে পার্শ্ববর্তী একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। সে এখন চতুর্থ শ্রেণির ১ম সাময়িক পরীক্ষা দিচ্ছে। স্কুল ড্রেস পরে যখন সে পরীক্ষা দিতে আসে তখন মনে হয় সে আমারই মেয়ে।
গত মঙ্গলবার তার পরিবারের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিতে তার স্কুলের পথে দাঁড়িয়েছিল। সমুহ বিপদ আশংকা করে সে অফিসে চলে আসে এবং এই যাত্রায় সে আবারো বেঁচে যায়। এখন প্রতিদিন আমার এক স্টাফ তাকে স্কুলে দিয়ে আসে এবং স্কুল থেকে নিয়ে আসে।
সে আমাকে বলে, তার দুঃস্বপ্ন এবং দুর্বিষহ অতীত ভুলে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চায়, বড় হয়ে টিএনও হতে চায়। আমিও চাই সে পড়ালেখা করুক। তার পড়ালেখার যাবতীয় খরচ আমি নিশ্চিত করতে চাই। স্বপ্ন দেখি সে হয়ে উঠুক একজন দৃষ্টান্ত। তাকে অনুসরণ করে হাজারো শরমিন বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাক। দেশ এগিয়ে দেওয়ার মিছিলে শরমিনও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিক।
লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।