কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : আমাদের গ্রামে ঢুকে কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় বর্মী সেনারা।এ সময় আরো অনেক বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। রাখাইন তরুণরা তলোয়ার ও দেশলাই হাতে নিয়ে আগুন দেয়ার পর বর্মি সেনাবাহিনী আমাকে জুলুম করেছে। বাধা দিতে গেলে ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। মিয়ানমার রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা সাত বছরের শিশু সাহারার মা উম্মে কুলসুম এ প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন। তিন বছরের শিশু নুরে জান্নাতকে কোলে নিয়ে সাত বছরের রোহিঙ্গা শিশু সাহারা ছোট বোনের কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। সরেজমিন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেখা হয় সাহারার সাথে। কেমন আছ? জানতে চাইতেই চোখ ভিজে উঠল। ছোট্র এই শিশু তার ভাষায় জানাল, বাবার জন্য পেট পোড়ের দে। অর্থাৎ বাবার জন্যে মন জ্বলে। সাহারা তার মায়ের সাথে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে ২০১৭ সালের অক্টোবরে। তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবেশিদের সঙ্গে পালিয়ে এসে এখন সে রয়েছে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে। প্রশ্ন ছিল কীভাবে সময় কাটে তার? গাহারা জানাল, ক্যাম্পের একটা মক্তবে পড়াশুনা করে সে, আর থাকে মায়ের সঙ্গে ক্যাম্পের ভেতর ভাড়া বাসায়।টেকুর বলতে গিয়েই কান্নায় গলা বুজে আসে তার, চোখে টলমল করে পানি। সাহারার মতো অসংখ্য শিশু উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছে। সরকারি হিসাব বলছে এদের সংথ্যা ৪০ হাজারের মতো। তবে এসব শিশু অন্য শিশুদের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। কারণ এরা কেউ বাবা হারা আবার কেউ বাবা মা দুজনই হারিয়েছেন। ছোট্র ঘরে তিন বছরের ছোট বোন নুরে জান্নাত কান্না করলে তাকে ঘরের বাইরে ক্যাম্পের এ দৃশ্য দেখিয়ে শান্ত করার পর কোলে করে বাড়ি ফেরার পথে এক ফাঁকে কথা বলছিলাম তার সাথে। সাহারার কথায় এখানে একেবারেই আমার মন বসে না। আমি মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। কারণ সেখানে আমার বাবার কবর আছে। গতকাল উখিয়ার ক্যাম্পগুলো ঘুরে আমি এমন শিশুর দেখা পেয়েছি, যারা তাদের বাবা মাকে হারিয়ে ফেলেছে। তারা এখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকছে। তাদের জন্য সরকারি বেসরকারি বেশকিছু উদ্যোগও চোখে পড়ল। উখিয়া উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান জানিয়েছেন,এতিম শিশুদের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার, তবে সেটা অল্প সময়ের জন্য। বেসরকারি সংস্থার ফান্ডে সরকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেটাও ছয় মাসের জন্য। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ৪০ হাজার শিশু যে পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসা এবং ভালোভাবে থাকার স্থান সেটা নেই। সব চেয়ে জরুরী যেটা দরকার সেটা হলো এতিম শিশুদের মানসিক সহায়তা দেয়া। যেটা একবারেই নেই। কারণ তারা বাবা মা হারিয়েছে তাদের সবচেয়ে বেশি মানসিক সাপোর্ট দরকার। নিয়ামত উল্লাহ বয়স ১২। থাকার জন্যে সেই অর্থে তার কোনো পরিবার মিলেনি। কুতুপালং ক্যাম্পে রাতটা কোনো রকম পার করে। সারাদিন রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় অথবা মক্তবে এসে পড়াশুনা করে। আমাদের বাড়িতে বোমা মারা হয়, বলছিলেন নিয়ামত উল্লাহ। ওই সময় বাড়ির বাইরে থাকায় আমি বেচেঁ যাই। আমার পরিবারের সবাই মারা গেছে। এতো অল্প বয়সে বাবা মাকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে দেখা এসব শিশুর মনের কষ্ট যে কোনো কিছুতেই মেটে না। সেটা তাদের বারবার ভিজে উঠা চোখ দেখলেই বোঝা যায়।