Home | উন্মুক্ত পাতা | মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন নেতা হয়েও কর্মী পরিচয় দিতে গর্ব করতেন

মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন নেতা হয়েও কর্মী পরিচয় দিতে গর্ব করতেন

160

মোঃ জামাল উদ্দিন : লোহাগাড়ার কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ নাজিম উদ্দিন। যিনি নেতা হয়েও নিজেকে কর্মী পরিচয় দিয়ে গর্ব অনুভব করতেন। ১৯৪২ সালের ১ জুলাই জন্ম নেয়া এ বীর ১৯৯৯ সালের ১৪ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর একমাস পর ১৪ মে চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল মডেল হাইস্কুলে তার স্মরণে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী ও নাজিম উদ্দিনের অন্যতম সুহৃদ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এ মন্তব্য করেছিলেন।

সেদিন আলোচনায় যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন যথাক্রমে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ডাঃ আবু ইউসুফ আলম, এস এম ইউসুফ, আবু ছালেহ, ডাঃ বিএম ফয়েজুর রহমান, সুলতানুল কবির চৌধুরী, এস এম আবুল কালাম, মোছলেম উদ্দিন আহমদ, এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, আবদুস ছালাম ও পরিমল দত্ত প্রমুখ। (তথ্যসূত্র- ড্রিমল্যান্ড প্রপার্টিস লিমিটেড এর সৌজন্যে নাজিম উদ্দিন শোকসভা প্রস্তুতি কমিটির ছাপানো পোস্টার)।

জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর একান্ত øেহভাজন এ মানুষটি ১৯৯৯ সাল হতে অনন্তকাল পর্যন্ত তাদের বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ের নৈঋর্ত (দক্ষিণ-পশ্চিম) কোণে শুয়ে থাকবেন। এ পুকুরে বঙ্গবন্ধু ডুব-সাঁতার কেটেছেন। মাছ ধরেছেন। ১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সন থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর হাতেই রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়েছেন। এ কথা সত্যি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাজিম উদ্দিনের মূল্যায়ন হতো। ১৪ এপ্রিল আসে-যায় কোনদিন তার মৃত্যুদিবস পালিত হয়না। শোকসভা হয়না। যে যার মত ব্যস্ত। ঝোপ-জঙ্গলে কবরটি ঢেকে রয়েছে। পরিস্কার করার লোক নেই। তার প্রিয় সংগঠন আওয়ামীলীগ আজ ক্ষমতাসীন। নাজিম উদ্দিনের সুহৃদ বন্ধু-বান্ধব আজ অনেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। এ ব্যাপারে আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

পটিয়া কলেজে উপাধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় তিনি তার রাজনৈতিক জীবন ও কর্মকান্ড সম্পর্কে জানান, তাঁর বড় ভাই মরহুম ডাঃ সিরাজ উদ্দিনের আমন্ত্রণে ১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সনে এম এ আজিজ ও জহুর আহম্মদ চৌধুরীসহ জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিক কাজে তাদের লোহাগাড়ার বাড়িতে আসেন। তিনি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু এতই ভালবাসতেন স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু যখন কক্সবাজার আসেন তখন অধ্যাপক নাজিম উদ্দিনকে না দেখে বঙ্গবন্ধু উতলা হয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কক্সবাজার থেকে অধ্যাপক নাজিম উদ্দিনকে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ একটি প্রাইভেট কার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জানা যায়, তিনি ১৯৫৮ সনের সামরিক শাসনজারীর পূর্ব পর্যন্ত ছাত্রলীগের কর্মী হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সনের ১৭ সেপ্টেম্বরের হরতালে ও ২২ সেপ্টেম্বরের প্রতিবাদ দিবসে ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৬৩ সনে রাজশাহী বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কার্যাক্রমে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪- ৬৫ সনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ কর্তৃক মনোনীত হয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রো-ভিসি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সনে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সনে ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালীন ছয় দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সনে বৃহত্তর সাতকানিয়া থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এ প্রসঙ্গে জানান, ১৯৬৯ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে সাতকানিয়া টাউন প্রাইমারী স্কুলে এম আর ছিদ্দিকীর নেতৃত্বে এবং একেএম আবদুল মন্নানের উপস্থিতিতে সাতকানিয়া থানা আওয়ামীলীগের কার্যকরী সংসদ গঠিত হয়। সেদিন আমার সহকর্মীবৃন্দ ও বন্ধুবর্গের সদিচ্ছা, সমর্থন ও ভালবাসাকে পাথেয় করে আইয়ুব-ইয়াহিয়া ও মোনায়েমের নির্যাতনের বিভীষিকার মুখে বুলেট খাওয়ার শপথ নিয়ে থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার আমি মাথায় তুলে নিয়েছিলাম। জাতীয় জীবনের দুর্যোগপূর্ণ বিপদ সঙ্কুল দিনের বাধা বিপত্তি এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমি যথাসাধ্য আমার দায়িত্ব পালন করেছি। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপটের লীলাভূমি বলে সাতকানিয়া থানার বরাবরই একটা কুখ্যাতি ছিল। বস্তুতঃ মুসলিম লীগ, জামায়া-ই-ইসলাম, নেজাম-ই- ইসলাম, ইসলামী ছাত্রসংঘ (বর্তমান শিবির) এবং পিডিপি চালিয়ে যাচ্ছিল ত্রাসের অবাধ রাজত্ব। তাই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ তথা ছয় দফার বিজয় অবধারিত সত্য বলে প্রতীয়মান হলেও সাধারণ্যে এমন এক ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, সাতকানিয়ায় তার ব্যতিক্রম ঘটবে। কিন্তু আল্লাহর কৃপা আর আওয়ামীলীগ কর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে জাতীয় পরিষদে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী আবু ছালেহ, প্রাদেশিক পরিষদে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ডাঃ বিএম ফয়েজুর রহমান বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ সে ধারণাকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছে। ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আমি ও আওয়ামীলীগের মনোনয় প্রার্থী ছিলাম। মনোনয়ন লাভে ব্যর্থকাম হলেও সংগঠনের স্বার্থে নির্বাচনী প্রধান হিসাবে নির্বাচনের কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মত আরও যাঁরা মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থকাম হয়েছিলেন তাঁরা হলেন আবু সালেহ, অধ্যাপক রূপেন কান্তি চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সমশুল হক চৌধুরী ও আবদুল গফুর। তাঁরাও আমার মত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে জয়যুক্ত করার কাজে নেমে আসেন। আমাদের সকলের সংগঠনের প্রতি আনুগত্য দর্শনে কর্মীবৃন্দ ও জনসাধারণের মনে কর্ম্মোদ্দীপনা জাগ্রত হয় এবং সকলের সহযোগিতায় এম ছিদ্দিক ও ডাঃ বিএম ফয়েজুর রহমান জাতীয় সংসদের নির্বাচনে জয়লাভ করেন। যেটি এসময়ে বিরল। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামীলীগের দ্বিধাবিভক্তি ও অন্তদলীয় কোন্দলের ফলে সাতকানিয়ায় আওয়ামীলীগ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা। ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সন পর্যন্ত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের শ্রম সম্পাদক ও ১৯৭৮ সন পর্যন্ত আজিজনগর আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম জেলা রসায়ন কর্পোরেশনের শ্রমিকলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৭০, ৭৩, ৭৭ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতকানিয়া- লোহাগাড়া নির্বাচনী এলাকার আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রধান ছিলেন। ১৯৮০ সনে পটিয়া কলেজ সরকারীকরণ করা হলে বিধি মোতাবেক সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকলেও সংগঠনের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত ছিলেন। ১৯৯১ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারী কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও সাতকানিয়া- লোহাগাড়া আসনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। কালের প্রবাহ থেমে থাকেনি। থাকেনা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অধ্যাপক নাজিম উদ্দিনরা নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করে গেছেন। শুধু দিয়েছেন। নেননি।

মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার নাম গেজেটভূক্ত হয়েছে (নং- ৩৬৭০, অতিঃ সংখ্যা জুন ২২, ২০০৬)। এ বীরের সম্মান রক্ষার্থে তার পরিবারের খোঁজ নিতে হবে। বেশী দূর যেতে হবেনা। লোহাগাড়া বটতলী মোটর ষ্টেশনে নেমে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি তাঁর ঠিকানা পেয়ে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!