
মোহাম্মদ মারুফ: লোহাগাড়ায় বোয়ালিয়া খালের পানি দীর্ঘদিন যাবত ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হয়ে পড়েছে। দূষণে কালো হয়ে যাওয়া খালের পানি থেকে আশপাশের ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আবাসিক এলাকায় প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। খালটি পরিচ্ছন্ন রাখার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, যার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে জনজীবন।
জানা যায়, উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের উত্তর কলাউজান মিশ্র বাপের পাড়া এলাকায় বিস্তীর্ণ কৃষি জমি থেকে বোয়ালিয়া খালের উৎপত্তিস্থল। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ প্রায় ৩০ ফুট। এই বোয়ালিয়া খাল কলাউজান ইউনিয়ন, লোহাগাড়া সদর ইউনিয়ন ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সীমান্ত তিন খালের মুখ এলাকায় মিলিত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, বোয়ালিয়া খাল লোহাগাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জলধারা। একসময় এই খালের পানি কৃষিকাজ, গোসল ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার হতো। পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ জলজপ্রাণী। কিন্তু বর্তমানে খালজুড়ে ময়লা, প্লাস্টিক, পলিথিন ও নোংরা বর্জ্যে ভরে গেছে। কালো হয়ে গেছে পানির রঙ, বাতাসে ছড়াচ্ছে পচা গন্ধ। খালটি বদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত ও সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। শুষ্ক মৌসুমে পচা পানির দুর্গন্ধ আশেপাশের বাড়িঘর, দোকান ও বিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে খাল পরিস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে খালের পানি বদ্ধ হয়ে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে দূরদূরান্তে। শিশু ও বৃদ্ধসহ এলাকার বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা যায়, বোয়ালিয়া খাল দখল ও দূষণে বর্তমানে মৃত প্রায়। খালের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা। কোথাও বাড়িঘর আবার কোথাও দোকানঘরসহ নানা স্থাপনা। খালের পাড়ে একাধিক স্থানে দেখা গেছে মলয়ার স্তুপ। পানিতে ভাসছে পলিথিন, পচা খাবার, প্লাস্টিক বোতলসহ নানা রকম বর্জ্য আর মশাসহ নানা ধরণের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ। দূষণের কারণে পানির রং কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তীব্র দুর্গন্ধে কয়েক মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। দখলের কারণে খালের কোনো অংশ ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত সরু হয়ে গেছে। ফলে খালের স্বাভাবিক গতিতে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। উপজেলা সদর ইউনিয়নের দরবেশহাটের পূর্ব পাশে খালের পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক কসাইখানা। পশু জবাইয়ের পর রক্ত আর নাড়ি-ভুড়ি এবং আশপাশের লোকজন ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালে। এছাড়া উপজেলা সদর বটতলী স্টেশনের নালা ও স্থানীয় লোকজনের সেপটিক ট্যাংকের নল খালের দিকে প্রবাহিত করা হয়েছে। বোয়ালিয়া খালের দূষিত পানি শুধু দুর্গন্ধই নয়, গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বহু বছর ধরে খালের কোনো নিয়মিত পরিস্কার কার্যক্রম নেই। বর্ষায় খালের পানি উপচে পড়ে আশপাশের বাড়িঘরে ঢোকে, আর শুষ্ক মৌসুমে দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায় হয়ে উঠে।
এদিকে, শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) সকালে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘বোয়ালিয়া খাল রক্ষা কমিটি’ নামে এক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করা হয়েছে। এতে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ শরীফকে আহবায়ক ও মোহাম্মদ এমরানকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরি পরিষদ গঠন করা হয়। এ সময় স্থানীয় মাসুদুর রহমান, ইলিয়াস হোসেন, শহিদুল ইসলাম, এএইচ টিপু, জসিম উদ্দিন, হাবিবুল্লাহ মিজবাহসহ নবগঠিত কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

আমিরাবাদের বাসিন্দা সাজ্জাদ হোছাইন জানান, বোয়ালিয়া খাল হলো একমাত্র খাল, যা উপজেলা সদর বটতলী স্টেশন এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। কিন্তু দখল ও দূষণের কারণে এই খাল আজ অস্তিত্ব সংকটে। একসময় যার জলধারা ছিল স্বচ্ছ, এখন তা বর্জ্য আর ময়লায় ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালের জীববৈচিত্র্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বোয়ালিয়া খাল বড় বড় ভবনের নিচে চাপা পড়বে। যার ফলে স্টেশন কেন্দ্রিক এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। তখন সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়। এখনই দরকার খাল দখলমুক্ত ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ।

আমিরাবাদে এম. এম সোলতান হোছাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেছে, খাল থেকে আসা দুর্গন্ধে শ্রেণি কক্ষে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। গরমের সময় দুর্গন্ধ আরো বেড়ে যায়। খালের পাশে স্কুল থাকায় প্রতিনিয়ত দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
স্থানীয় পরিবেশবাদিরা জানান, বোয়ালিয়া খালের দখল ও দূষণ বন্ধ না হলে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। খাল শুধু পানি নিস্কাশনের পথ নয়, এটি স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের অংশ। এখনই খাল রক্ষা অভিযান শুরু না করলে এটি পুরোপুরি মৃত জলাশয়ে পরিণত হবে। দখলদারদের উচ্ছেদ করে খালের সীমানা নির্ধারণ, নিয়মিত খাল পরিস্কার কার্যক্রম ও তদারকি জোরদার, স্থানীয় জনগণকে ময়লা না ফেলার বিষয়ে সচেতন করা ও প্রশাসনের নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে খালটি একদিন হারিয়ে যাবে।

লোহাগাড়া উপজেলা স্যানিটারী ইন্সপেক্টর মুহাম্মদ শের আলী জানান, সরকারি খাল, ছড়া ও ঝিরির পানি দূষণ করা দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ২৭৭ ধারার অধীনে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বাস্থ্য বিভাগ এই ধারায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একই সাথে এটি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর অধীনেও অপরাধ। যা পরিবেশ অধিদপ্তর প্রয়োগ করে।

লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ ইকবাল হোসাইন জানান, দূষিত পানির গ্যাস ও দুর্গন্ধ দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসনালীর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া খালের আশপাশের এলাকায় ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, এলার্জি ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, খাল দখল ও দূষণ করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। বোয়ালিয়া খাল দখল ও দুষণমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Lohagaranews24 Your Trusted News Partner