- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

বাবা

23

ওমর ফারুক : যে বছর বড় ঝড় হয়েছিল; মানুষের বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হয়েছিল, সেই বছর ই দিলরুবা আমার ভাঙ্গা বাড়িতে বউ হয়ে আসে। লিকলিকে শরীর, দোহারা গঠন, বেণী করা চুল, দুধে আলতা গায়ের রঙ; চোখে কিশোরী চাহনি আর মুখ ভর্তি লজ্জা।

বাস চলছে। বাতাসের দমকা হাওয়া আরো বাড়ছে।নয়টায় ট্রেনিং। এখন বাজে নয়টা চল্লিশ। অর্ধেক পথ বাকি; কখন যে পৌঁছাবো আল্লাহ মালুম। সারা বাস ভর্তি যাত্রী। লোকাল বাস গুলোর পেট বোয়ালমাছের পেটের মত। আমার এক বন্ধু মজা করে বলে, রাজার যেমন রাজ্যে কুলায় না, তেমনি লোকাল বাসের ড্রাইভারেরও প্যাসেঞ্জারে কুলায় না। অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বসার জায়গা পেয়েছি।জানালার পাশে সিট। লোকাল বাসে জানালার পাশে সিট পাওয়া অনেক বড় কপালের ব্যাপার। জানালার পাশে বসতে বসতে পাশের যাত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাতে যাবো কিন্তু বৃষ্টির ছিটকায় ভিজে গেলাম; কৃতজ্ঞতা আর জানানো হল না। জানালা ভাল করে টেনে দিলাম।পাশের যাত্রী তার গল্প বলে যাচ্ছে। মাথায় ট্রেনিংয়ে পৌঁছানোর টেনশন; কিছু ঢুকছে না। পাশের সিটের যাত্রীর অহেতুক বকরবকর অসহ্য লাগছে।

বিয়ের প্রথম ক’বছর আমাদের ভালয় ভালয় চলছিল।ছোট চাকরি; মাস দুই পরপর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ মিলত। বউয়ের জন্য স্নো পাউডার, লিপস্টিক, বাহারি রঙের চুড়ি নিয়ে যেতাম। বাড়ি পৌঁছানোর দিন আমি কতটুকু আসছি; তা জানার জন্য বউ আমার ব্যাকুল হয়ে উঠত। তার অস্থিরতায় বিরক্তি দেখাতাম, মনে মনে অবশ্যই ভালই লাগত।

কিশোরী বউ আমার আস্তে আস্তে মহিলা হয়ে উঠে।এদিকে আশেপাশের লোকজনেরও কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। সজীবের বিয়ে হল এতদিন, এখনো বাচ্চা হচ্ছে না কেন? একদিন মা ডেকে বলে, সজীব তোর বউকে ডাক্তার দেখা। এতদিনও নাতি নাতনির মুখ দেখাতে পারল না। বউ মায়ের কথা শুনে নীরবে কাঁদে।
চাকরিতে চলে আসার দিন তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলি, একদিন আমাদের ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে। বউ অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। বউকে রেখে চলে আসি।

পাশের যাত্রীর কথা ট্রেনিং এর দুশ্চিন্তা থেকে আমাকে সরাতে পারে না। তারপরও শুনছি অনুরোধের ঢেঁকি গেলার মত। এরকম তো অনেক হয়। এসব আয়োজন করে বলার কি আছে। বিরক্ত লাগে। উনি আমার বিরক্তি বুঝেও বলে যাচ্ছে।

একদিন বউ ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল।কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারছি না। অনেকক্ষণ পর দম ফেলতে ফেলতে বলল, জয়নব খালা এসে বলে গেছে আমি নাকি কখনো মা হতে পারবো না। শুনে মনটা ভেঙে গেল। আমি কোনদিন বাচ্চা নিয়ে তাড়াহুড়ো করি নাই। আল্লাহ যখনি চায় তখনি হবে।অথচ পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন আমাদের সুখের সংসারে দুঃখের বীজ বপন করে দিয়েছে বাচ্চা বাচ্চা করে।

বাস চলছে। বৃষ্টি আরো বাড়ছে। পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে। হুম হুম করে আমি গল্প শুনে যাচ্ছি। আস্তে আস্তে গল্পের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। তারপর কি হল জানার জন্য আমার তর সইছে না। একটু পরেই তো আমি নেমে যাবো। কিন্তু পাশের যাত্রী আয়েশি ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছেন। এক পর্যায়ে বলে ফেললাম, তারপর কি হল; তাড়াতাড়ি করেন; আমার নামার সময় হয়ে যাচ্ছে।

একবার বাড়ি গিয়ে দেখি আত্মীয় স্বজনের মিলন মেলা পুরো ঘর জুড়ে। সব বোন,খালা, ফুফুরা আসছে।আমার রুমে ঢোকার সময়, এক খালা কারে জানি মোবাইলে ফিসফিস করে বলছে সজীব আসছে এইমাত্র, তুমিও চলে আস। অন্য সময় রুমে ঢুকলে আগবাড়িয়ে ব্যাগটা টেনে নিত বউ। আজকে রাজ্যের সব অন্ধকার বউয়ের দুই চোখ জুড়ে। আমার ভয় হয়।

সেদিন রাতে দিলরুবা ও আমাকে নিয়ে বাড়িতে মিটিং হল। শেফালী খালা মিটিং পরিচালনা করে। আমি ছাড়া মিটিং এ উপস্থিত সবাই আমাদের সন্তান না হওয়া নিয়ে খুবই চিন্তিত। শেফালী খালা বলল, তুই বাড়ির একমাত্র ছেলে। এতদিন হল তোর বউয়ের বাচ্চা হল না। তোর বউ ভাজা। তার বাচ্চা হবে না। বংশে বাতি জ্বালানোর জন্যও একটা বাচ্চা দরকার। তুই তোর মাজেদা খালার মেয়ে বকুলকে বিয়ে করে ফেল।বকুল রাজি আছে। আমি বললাম, আমার দিলরুবা রাজী আছে? খালা বলল, বন্ধ্যা মেয়ের এত রাজি হওয়ার কি আছে? বললাম, আমার সমস্যার কারনেও তো বাচ্চা না হতে পারে। তুই বেশি বুঝিস বলে মাজেদা খালা রেগে গেল। মিটিং ভাল লাগছিল না। থামানোর জন্য সবাইকে বললাম, আপনারা রাতে খাওয়াদাওয়া করে নেন। সকালে নাস্তা করে চলে যাইয়েন। ঘরের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গেল।

সহ যাত্রীকে আবার তাগাদা দিলাম। গল্প শেষ করেন।আমাকে নামতে হবে। আর দু’তিন মিনিট পর নামতে হবে। তাড়াতাড়ি শেষ করেন। কি হলো এরপর?

বারবার তাগাদায় উনি শশব্যস্ত হয়ে বললেন, আজ সকালে বাবা হয়েছি। দিলরুবা মা হয়েছে। আমার দিলরুবা ভাজা নয়। আমাদের আরাধ্য সেই সন্তানকে দেখতে যাচ্ছি। শুনে মনটা ভাল হয়ে গেল। অভিনন্দন জানিয়ে নেমে পড়লাম।

লেখক : সহকারী শিক্ষা অফিসার, লোহাগাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।