ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | নীরবেই বাড়ছে কিডনি রোগ

নীরবেই বাড়ছে কিডনি রোগ

নিউজ ডেক্স : দেশে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি রোগ নামক এই নীরব ঘাতকের ব্যাপকতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ বুঝতেই পারেন না তাদের কিডনি আক্রান্ত হতে বসেছে। রোগের জটিল পর্যায়ে (ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে) পৌঁছলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন অধিকাংশ রোগী। তখন আর কিডনি প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস ছাড়া উপায় থাকে না। কিডনি এবং কিডনি রোগ নিয়ে সচেতনতার অভাবই এর মূল কারণ। অথচ, কেবল সচেতনতার মাধ্যমেই ৬০ শতাংশ কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ নির্ণয় করা গেলে নিরাময় সম্ভব। কিন্তু এটা নীরব ঘাতক হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় সম্ভব হয় না। যখন রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসেন, তখন কিডনি প্রতিস্থাপন অথবা ডায়ালাইসিস ছাড়া উপায় থাকে না। এক্ষেত্রে কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল। অধিকন্তু দেশের কিডনি রোগীর মাত্র ১০ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন এবং ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকে। আর বাকি ৯০ শতাংশই বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। কারণ এর চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে রোগটির প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকেই জোর দেয়া জরুরি বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসকরা বলছেন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, নেফ্রাইটিস (কিডনিতে এক ধরণের ইনফেকশন), মূত্র তন্ত্রের বাধা, জন্মগত কিডনি রোগ, পাথর রোগ এবং গর্ভাবস্থা ও শল্য চিকিৎসার জটিলতায় আক্রান্তদের কিডনি রোগের ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া ব্যাথানাশক ও কিডনির অন্যান্য ক্ষতিকর ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং ধুমপানও কিডনি রোগের অন্যতম কারণ। বর্তমানে ডায়াবেটিস বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল হুদা বলেন- আগের তুলনায় কিডনি রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। গত দশ বছরে রোগীর সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে।

কিছু বিষয় মেনে চললে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে কিডনি সুস্থ রাখা সম্ভব। কিডনিকে সুস্থ রাখতে হলে করণীয় সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন- কিডনি রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যাথানাশক ওষুধ ও এন্টিবায়েটিক খাওয়া থেকে বিরত থাকা, সুষম (পুষ্টিকর) খাবার খাওয়া, ধুমপান পরিহার ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। তাছাড়া কিডনি রোগের প্রয়োজনীয় তথ্য জানা, পরিবারের কোন সদস্যের কিডনি রোগ থাকলে নিজের কিডনি পরীক্ষা করার পাশাপাশি বাৎসরিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতি জোর দিয়েছেন ডা. মো. নুরুল হুদা।

উল্লেখ্য, সারাবিশ্বের ৯০টি দেশে বিশ্ব কিডনি দিবস পালিত হচ্ছে আজ। প্রতি বছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য- জ্ঞানের সেতুবন্ধনে সাফল্য’। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের ন্যায় চট্টগ্রামেও দিবসটি উদযাপন করছে চট্টগ্রাম কিডনি ফাউন্ডেশন ও চমেক হাসপাতালের কিডনি বিভাগ। দিবসটি উপলক্ষে আজ বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে চমেক হাসপাতালের কিডনি বিভাগ। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান। কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল হুদার সভাপতিত্বে চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সাহেনা আকতার, চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান, কিডনি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. দীপ্তি চৌধুরী প্রমূখ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।

কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও চমেক হাসপাতালের কিডনি বিভাগের (নেফ্রোলজি) প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুসের মতে- কিডনি ও কিডনি রোগ নিয়ে সচেতন হওয়া খুব বেশি জরুরি। মাত্র ২০ শতাংশ রোগ রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে কিডনি আক্রান্তের বিষয়টি ধরা পড়ে। আর ৮০ শতাংশ রোগ পরোক্ষভাবে কিডনিকে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিসসহ এই ৮০ শতাংশ রোগ হলে কিডনি আক্রান্তের বিষয়টি মানুষ বুঝতে পারে না। ফলে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগে আক্রান্তের বিষয়টি ধরা পড়ে না। এতে করে মানব শরীরের অপরিহার্য এই অঙ্গটি ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। মানুষ নিজের কিডনি ও কিডনি রোগ নিয়ে সচেতন নয় বলেই এমনটি ঘটে। অথচ, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের বিষয়টি জানতে পারলে এ রোগ নিরাময় সম্ভব। এ রোগের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল মন্তব্য করে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, দুটি পরীক্ষা করে (সিয়াম ক্রিয়েটিনিন ও ইউরিন এলবুমিন) শরীরের কিডনির অবস্থা সম্পর্কে মানুষ সহজেই জানতে পারে। নিজ থেকে এ পরীক্ষাগুলো করা যায়। খরচও বেশি নয়। এই পরীক্ষা দুটি করলে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি সম্পর্কে জানা যাবে। আর প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হলে এ রোগ থেকে নিরাময়ের সুযোগ থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। নিম্ন-মধ্যবিত্ত রোগীদের পক্ষে এ ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। ফলে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। ডায়ালাইসিস কেন্দ্রের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু এর সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এগুলো বড় প্রতিবন্ধকতা। এছাড়াও এ রোগের চিকিৎসায় অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে – সময়মতো রোগ নির্ণয়ে অসচেতনতা, ডায়ালাইসিস কেন্দ্র বা মেশিনের অপ্রতুলতা, উচ্চ খরচ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার উচ্চ ব্যয়, ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর উচ্চ মূল্য, দক্ষ চিকিৎসা সেবা প্রদানকারীর অভাব, চিকিৎসা সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, যথাযথ তদারকি ও পরীবিক্ষণের অপ্রতুলতা এবং চিকিৎসা সেবায় আরোপিত ভ্যাট ও ট্যাঙ।

সূত্রে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি খাতে এই রোগের চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বেড়েছে। এখন সারাদেশে প্রায় ৯০টিরও বেশি কেন্দ্রে ডায়ালাইসিস হয়। কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র রয়েছে ১১টি। চট্টগ্রামে কিডনি রোগের চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে ৯টি। এছাড়া, ৫টি কেন্দ্রে ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায় এ রোগে আক্রান্তরা। সরকারি হাসপাতালে প্রতিবার ডায়ালাইসিসে খরচ পড়ে ৪ থেকে পাঁচশ টাকা। অন্যদিকে, বেসরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতালে এ খরচ আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।

চমেক হাসপাতালের নিচতলায় স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সেন্টারে ৩১টি মেশিনে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়। হাসপাতালের মাধ্যমে আসা রোগীদের প্রতি সেশনে ৪৮৬ টাকা ফি দিতে হয় এই সেন্টারে। তবে অন্যান্য রোগীদের প্রতি সেশনে ফি দিতে হয় ২ হাজার ৬৬৩ টাকা। ২০২১ সালে (এক বছরে) মোট ২৯ হাজার ৮৯০ সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়েছে এই সেন্টারে। একই সময়ে (গত এক বছরে) মোট ৩ হাজার ৪০০ সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়েছে হাসপাতালের কিডনি বিভাগে। কিডনি বিভাগে বর্তমানে ৭টি মেশিনে এই ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল হুদা। এর বাইরে করোনা ইউনিটে ৩টি মেশিনে ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয় জানিয়ে ডা. মো. নুরুল হুদা বলেন, করোনা ইউনিটে গত এক বছরে ১ হাজার ৩৩০ সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত কিডনি রোগীদের এই (করোনা) ইউনিটে আলাদা ভাবে ডায়ালাইসিস সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

স্যান্ডর সেন্টারে ২০২০ সালে এক বছরে মোট ৩১ হাজার ১৪৩ সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেন্ডর ডায়ালাইসিস সেন্টারের ম্যানেজার (একাউন্ট এন্ড ফাইনান্স) নাজমুল হাসান। এছাড়া ২০১৯ সালে ৩০ হাজার ৮২৬ সেশন, ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৭০১ সেশন ও ২০১৭ সালে ১২ হাজার ১৫৩ সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। অন্যদিকে, হাসপাতালের কিডনি বিভাগে ২০২০ সালে মোট ৩ হাজার ১০৩ সেশন এবং ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৬০০ সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দেয়া হয় বলে কিডনি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

কিডনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল হুদা বলেন, গত এক বছরে ৪ হাজার ৭০০ রোগী বিভাগে ভর্তি থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। আর বর্হিঃবিভাগে (আউটডোরে) চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন প্রায় ৫ হাজার রোগী। সব মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটা এলার্মিং বলা যায়।

কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুস বলেন, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যায় এমন অধিকাংশ মানুষ প্রথমে উপসর্গ বুঝতে পারে না। এতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি হয়। যখন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় ততদিনে কিডনির কার্যকারিতা প্রায় ৭৫ শতাংশ লোপ পায়। ওষুধ দিয়ে এই রোগী পরিপূর্ণ সুস্থ করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। শুধু কিডনি নয়, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়েও মানুষ উদাসীন। অনেকে জানে না, এ থেকে মারাত্মক কিডনি রোগ হয়। এ রোগগুলো নিয়ে সচেতনতার বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। -আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!