- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে হজ পালনের আশা পূরণ হলো না মা হালিমার

নিউজ ডেক্স : ‘পাকা ঘরে ঘুমানোর স্বপ্ন আমার পূরণ হলো না। সারাজীবন খেটে মরেছি। সুখের দেখা পাইনি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে একটানা ১৫ বছর অন্যের বাড়িতে দিন মজুরের কাজ করেছি। পরে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটে বিক্রি ও ঋণ নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলাম।

সেখানে টানা ২৬ বছর খেজুর বাগানে কাজ করেছি। খেটে মরেছি, কিন্তু সুখের দেখা পাইনি। আমার বিক্রি করা জমিতে নির্মিত ঘরে আমি ভাড়া দিয়ে থাকছি। একপর্যায়ে সুখের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার শ্যালকের টাকায় দুই ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে আবারো স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। ছেলেদের উপার্জন ও ধার করা টাকায় একটি ভিটেও কিনেছি। ছেলেরা বলেছিল বিদেশ থেকে এসে সেই জায়গায় একটি পাকা ঘর করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হলো না। এর আগেই আগুন আমার দুই ছেলেকে কেড়ে নিল। তারা ফিরবে না, আমার জন্য আর পাকা ঘরও করে দিতে পারবে না।’ কথাগুলো বলছিলেন মদিনায় সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া লোহাগাড়ার মিজানুর রহমান ও আরফাতুজ্জামান মানিকের বাবা সুলতান আহমদ।

লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ সুখছড়ি নাজির আলী পাড়ার ভাড়া বাসার একটি কক্ষে গতকাল দুপুরে কান্না বিজড়িত কন্ঠে সুলতান আহমদ বলেন, ‘গত একবছর আগে দুই ছেলেকে সৌদি আরবে রেখে আমি দেশে চলে আসি। আমি টানা ২৬ বছর বিদেশে থাকলেও আমার টাকায় ছেলেদের নিতে পারিনি। তাদের মামার টাকায় সৌদি আরবে গেছে। ছোট ছেলে মানিক মামার দোকানে আর মিজান একটি সোফা কারখানায় কাজ করতো। গত এক মাস আগে তাদের মামার দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন মিজান তার ছোট ভাই মানিককে সোফা কারখানায় নিয়ে যায়। আর সেই সোফা কারখানায় পুড়ে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়।’

কিছুক্ষণ পরপর বিলাপ করতে করতে সুলতান আহমদ বলেন, ‘আমি সৌদি আরব থেকে আসতে চাইনি। আমার ছেলেরা জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেদিন তারা বলেছিল, জীবনে অনেক খেটেছো। এখন আমরা বড় হয়েছি। আর খাটতে হবে না। এখন দেশে থাকবে। আমরা টাকা পাঠাব, আর তুমি ইচ্ছে মতো খরচ করবে। নিজের পছন্দ মতো একটি বাড়ি করবে। সেদিন তারা মাকে ফোন করে বলেছিল আমি দেশে আসার পর যেন আমার পাসপোর্টটি পুড়ে ফেলে। পাসপোর্ট পুড়ে ফেললে আমি আর বিদেশে যেতে পারব না। ছেলেদের কথা মতো আমার স্ত্রী বারবার চেষ্টা করে পাসপোর্ট পুড়ে ফেলার জন্য। কিন্তু আমি সেই সুযোগ দিইনি। আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে তারা না ফেরার দেশে চলে গেছে। আমার ছেলেরা আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে বুঝতে পারিনি। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার বাঁচার সম্বল দুটো শেষ। এখন আমার শেষ ইচ্ছে, সৌদি আরবে গিয়ে মারা যাওয়া। যেখানে আমার ছেলেরা ঘুমিয়ে থাকবে সেখানে তাদের পাশে ঘুমানো। সৌদি আরবে গিয়ে মরতে পারলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমি আর কিছু চাই না।’

সুলতান আহমদ এসব কথা বলতে বলতে অন্য কক্ষ থেকে ভেসে আসছিল মিজান এবং আরফাতুজ্জামান মানিকের মা হালিমা বেগমের কান্নার আওয়াজ। বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘পুত্রবধূর মুখ দেখা হলো না আমার। একই দিনে দুই ছেলের বিয়ে দেওয়া হলো না। পাকা ঘরে ঘুমানোর সাধ আমার পূর্ণ হলো না। তার আগেই আমার বুক খালি করে দুই ছেলে চলে গেল। তিনি জানান, কিছুদিন আগে ছেলেদের সাথে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল। তখন তাদের বলেছিলাম দুই জনকে একসাথে দেশে আসতে। একই দিনে দুই ছেলের বউকে ঘরে তুলব। তারাও কথা দিয়েছিল আগামী দুই মাস পরে একসাথে দেশে আসবে। পাকা ঘর করবে। একই দিনে দুই ভাই বিয়ে করবে। আমাকে দুই পুত্রবধূর হাতের রান্না খাওয়াবে। কথা রাখেনি, তারা আমাকে ফাঁকি দিয়েছে।’

হালিমা বেগম জানান, ‘দুই ছেলে বারবার বলেছিল আমাকে হজে যাওয়ার জন্য। তাদের কথা মতো পাসপোর্টও করেছিলাম। করোনার কারণে গতবার যাওয়া হলো না। আশা ছিল আগামীবার হজে যাব। দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে হজ পালন করব। আমার সেই আশা আর পূরণ হলো না। এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচব?’ দৈনিক আজাদী