- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

ড্রাগন ফলের চাষ করে স্বাবলম্বী

Dragon-2

নিউজ ডেক্স : বিয়ের কয়েক বছর পর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় পাঁচ–ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণ–পোষণ চালানোর জন্য কায়িক শ্রমও দিতে পারছিলেন না স্বামী আবুল কালাম আবেদীন। তখন চোখে–মুখে অন্ধকার দেখে আমি (আয়েশা বেগম) অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করি। পাশাপাশি সময় পেলেই বন থেকে লাঁকড়ি সংগ্রহ করে তা বেচে অনেক কষ্টেসৃষ্টে সংসারের হাল ধরি। এভাবে কয়েকবছর শ্রম দিয়েও দুই বেলা ভাত জুটাতে পারছিলাম না। তার ওপর সন্তানরা বড় হচ্ছে, তাদেরকেও পড়ালেখা করাতে হবে এমন চিন্তায় দিন দিন নিজের শরীরের অবস্থাও কাহিল।

আয়েশা বেগম বলেন, ‘এরই মাঝে নেকম–ক্রেল প্রকল্পের এক মাঠকর্মীর নজরে আসি আমি। দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলা পরিবারের অভাব–অনটন থেকে কিভাবে উঠে দাঁড়াতে পারি সেই সাফল্যের গল্প ওই মাঠকর্মী শোনান আমাকে। পরে তাঁর কথামতো নিজের ১০ শতাংশ জায়গায় প্রথমে শুরু করি বিভিন্ন সবজির আবাদের। সবজি চাষ করে একটু একটু লাভের মুখ দেখার পর আমার মনেও যেন নতুন করে আশার সঞ্চার হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সবজি চাষে যখন সফলতা হাতছানি দিচ্ছিল তখন নেকম–ক্রেল প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণ নিই ড্রাগন ফল চাষের। বিনামূল্যে এই ফলের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর আমাদের ১০ শতাংশ জায়গায় মাদার চাষ হিসেবে ড্রাগন ফলের চারা রোপন করি। অবশ্য সেখানে সাথী ফসল হিসেবে সবজিরও আবাদ হচ্ছে।’

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য ঘেঁষা চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের হায়দারনাশী গ্রামের সফল ড্রাগন চাষি আয়েশা বেগম দৈনিক আজাদীকে জানান, বর্তমানে তাঁর ড্রাগন ফলের পিলার রয়েছে ১২টি। তন্মধ্যে প্রতি পিলারে তিনটি করে চারা রোপন করা আছে। মাত্র ১০ শতাংশ জায়গায় ১২ পিলারের ৩৬টি ড্রাগন চারায় ফল দেওয়াও শুরু করেছে।

আয়েশা বলেন, ‘প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে (গরম) ড্রাগন চারায় ফল আসা শুরু করে। যা শীতমৌসুমের আগ পর্যন্ত ফল দেওয়া বিদ্যমান থাকে। এই ড্রাগন ফল বিক্রি করে প্রতিমৌসুমে বাড়তি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব হচ্ছে আমার। প্রতিকেজি ড্রাগন ফল প্রকারভেদে বিক্রি করা হচ্ছে ৫শ থেকে ৬শ টাকার মধ্যে।’

তিনি বলেন, ‘একসময় সবজি চাষকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও এখন ঝুঁকে পড়েছি ড্রাগন ফল চাষে। পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে আবাদ করা হচ্ছে মরিচ, বেগুন, টমেটো, শিমসহ রকমারী সবজির। এতে বাড়তি আয়ও হচ্ছে। আর এসব আয় দিয়ে আমার পরিবার এখন আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল।

এতে তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে ও একমাত্র কন্যা সন্তানকে স্কুলে পড়ছে। বড় ছেলে পড়ছে ৬ষ্ট শ্রেণিতে, মেঝ ছেলে ৫ম শ্রেণি এবং কন্যা সন্তান পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। আবার কাজের অভাব এবং আর্থিক টানাপড়েনে পড়ে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়া স্বামীও চিকিৎসা পেয়ে এখন ভাল হওয়ার পথে। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে নেকম–ক্রেল প্রকল্পের সহযোগিতা পাওয়ায়।’

নেকম–ক্রেল প্রকল্পের সাইট অফিসার আব্দুল কাইয়ুম জানান, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য সংলগ্ন হায়দারনাশী গ্রামে বাস আয়েশা বেগমের। স্বামী আবুল কালাম আবদীনসহ চার ছেলে–মেয়ে নিয়ে খুব অভাবেই চলছিল তাদের সংসার। পেটে দু–মুঠো ভাত দেওয়ার তাগিদে শিশু সন্তানদের নিয়ে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যে প্রবেশ করে কঁচি গর্জন গাছ কেটে জ্বালানি সংগ্রহ করে তা পাশের বাজারে বিক্রি করে কোনমতে দিন কাটাচ্ছিল আয়েশা। এই অবস্থায় নেকম–ক্রেল প্রকল্পের কর্মীদের সু–দৃষ্টিতে পড়ে আয়েশা বেগম। তাকে বুঝানো হয় একটি কঁচি গাছের মাঝে একটি মা গর্জন গাছের ভবিষ্যৎ এবং গাছ কিভাবে মানুষের উপকার করে তা। ক্রেল কর্মী ও সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটির কথায় আয়েশা বেগমের বুঝে আসে। তিনি হায়দারনাশী গ্রাম সংরক্ষণ দলের একজন সদস্য হন। ক্রেল প্রকল্পের পক্ষ থেকে তাকে ড্রাগন ফল চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি প্রতিমৌসুমে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বাড়তি আয় করছেন। এছাড়াও একই জমিতে সাথী ফসল হিসেবে সবজি ফলিয়েও প্রতিমাসে অন্তত তিন হাজার টাকা আয় করছেন। আবার ড্রাগনের কাটিং বিক্রি করেও বাড়তি আয় করছেন তিনি। ছেলে–মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। পার্শ্ববর্তী মহিলারাও এখন তার কাছ থেকে ড্রাগন ফলের চাষ শিখছেন ও কাটিং সংগ্রহ করছেন। সংসারে আয়েশার এখন সুখের বাতাস বইছে। ছেলে–মেয়ে ও স্বামীর মুখে হাসি ফুটেছে।

নেকম–ক্রেল প্রকল্প সূত্র জানায়, বিকল্প জীবিকায়নে নেকম–ক্রেল প্রকল্পের অনন্য উদ্যোগের ফলে সবুজ প্রকৃতি বাচাঁতে ড্রাগন ফল চাষ অনন্য অবাদান রাখছে। কক্সবাজার–চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪৮ কিলোমিটার উত্তরে চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যে চোখে পড়ে নয়নাভিরাম সবুজ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যে ভরপূর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের বনভূমি। বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞপ্তি নং পবম/শা/৫/৬৭৮৫ তারিখ ০২/০৬/২০০৭ মূলে গ্যাজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ১৩০২ হেক্টর বনভূমি নিয়ে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়। অভয়ারণ্যটি রক্ষা ও এর উপর নির্ভরশীল মানুষকে বিকল্প জীবিকায়ন সৃষ্টিতে নিবিড়ভাবে কাজ করছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং ইউএসএই্‌ড এর নেকম–ক্রেল প্রকল্প। বন ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ, পরিবেশ–প্রতিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও পরিবেশবান্ধব টেকসই জীবিকায়ন নিয়ে কাজ করা এবং সংশিহ্মষ্ট সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটি ও ষ্টেকহোল্ডারদের সাথে সমন্বয় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পর গত কয়েকবছরে আমূল পরিবর্তনও এসেছে।

নেকম–ক্রেল প্রকল্পের সাইট অফিসার আব্দুল কাইয়ুম আরো বলেন, হায়দারনাশীর মতো ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য ও মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় জাতীয় উদ্যানের আরও ৪৩টি গ্রামের বন নির্ভরশীল ৫০০০ মানুষকে নির্বাচন করে ক্রেল প্রকল্প সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটির সহযোগিতায় ড্রাগন ফলের চাষ, টুপি তৈরি, খেলনা তৈরি, ঝুড়ি তৈরি, উন্নত মানের সবজি চাষ, ষ্ট্রবেরী চাষ, ক্যাপসিকাম চাষ, হাঁস–মুরগি পালন, উন্নত চুলা তৈরি ও বিতরণসহ আরও অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এতে আয়েশা বেগম, রাশেদা বেগম, রূপাইয়া বেগম, আছিয়া খাতুন, খাদিজা আক্তার, জান্নাত আরা, শামছুদ্দিন, আব্দুস শুক্কুরসহ অনেক বননির্ভরশীল পরিবার ক্রেল প্রকল্পের প্রশি ণের আওতায় এসে স্বাবলম্বি হচ্ছে। পাশাপাশি কমছে বনের উপর ঝুঁকি। এছাড়া ড্রাগন ফল দৃষ্টিনন্দন এবং সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হওয়ায় কক্সবাজারে আগত পর্যটকদেরও দৃষ্টি কাঁড়ছে।

কাইয়ুম জানান, একেকটি ড্রাগন ফলের ওজন বেশি। দুটি বা তিনটিতেই এক কেজি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর গরম আসলেই ফল ধরা শুরু করে। যা শীতমৌসুম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ৪ থেকে ৫ বার ফল তোলা যায়। একটি চারা থেকে একটানা ২৫ বছর পর্যন্ত ড্রাগন ফল পাওয়া যায়। এছাড়াও সাথী ফসল হিসেবে সবজির আবাদ তো থাকেই। এভাবে নেকম–ক্রেল প্রকল্পের অধীনে ৩৪টি ড্রাগন ফলের প্রদর্শনী খামার গড়ে তোলা হয়েছে।

আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘ক্রেল প্রকল্প পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিযোজন ও প্রশমন, সামাজিক বনায়ন এর উপর সচেতনতা বৃদ্ধিসহ আয়োজন করছে বিভিন্ন প্রশি ণেরও।

ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যের নিকটস্থ ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটিকেও শক্তিশালী করে তাদের বাৎসরিক কর্ম পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনজনিত কর্ম পরিকল্পনা সম্পৃক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এতে হতদরিদ্র আয়েশা বেগমের মতো হাজারো পরিবারকে স্বাবলম্বী করে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যের সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটিকে একটি শক্তিশালী ও টেকসই সংগঠন হিসেবে দাঁড় করিয়ে বন, পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্যকে রক্ষায় সু–প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এই নেকম–ক্রেল প্রকল্প।’ –আজাদী