- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

চিরনিদ্রায় শায়িত আনিসুল হক

anis-20171202171630

নিউজ ডেক্স : কাঁদছে নগর, কাঁদছে নগরবাসী। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে কাঁদছেন মিডিয়াপাড়ার মানুষরাও। কান্নার রোল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। ওই হাসিমাখা মুখ মাটিচাপা দেয়া যায়! কী করে ভুলবে এমন ভালোবাসার মানুষকে! তবুও যে বিদায় দিতে হয়। এ যে অমোঘ বিধান। এ বিধান লঙ্ঘন করার সাধ্য কার? ভালোবাসার অশ্রুভেজা মাটিতেই চাপা দিতে হলো। সবাইকে কাঁদিয়ে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক।

শনিবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বনানী কবরস্থানে ছোট ছেলে শারাফুল হকের কবরে দাফন সম্পন্ন হয় আনিসুল হকের। দাফন শেষে দোয়া পড়ান সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব মাহমাদুল হক। জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। মন্ত্রী, এমপিসহ রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এতে অংশ নেন।

এর আগে বিকেল ৪টা ১৯ মিনিটে বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে মরহুমের জানাজা সম্পন্ন হয়। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মেয়রের মরদেহ বহনকারী বিমানটি সিলেটে এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। এরপর দুপুর ১টার দিকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় ফ্লাইটটি। পরে সেখান থেকে দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে মরদেহ বনানীতে তার নিজ বাসায় নেয়া হয়।

মরদেহ দেখতে এবং শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের আনিসুল হকের বাড়িতে যান। এরপর বেলা ৩টার দিকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আর্মি স্টেডিয়ামে। মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদেনের জন্য সেখানে খানিক সময় রাখা হয়। জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় আনিসুল হককে।

গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২৩ মিনিটে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের দ্য ওয়েলিংটন হাসপাতালে তিনি মারা যান আনিসুল হক। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।

এর আগে ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবার যুক্তরাজ্য যান তিনি। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১৩ আগস্ট তাকে লন্ডনের ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার মস্তিষ্কে প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। এরপর তাকে দীর্ঘদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে তার শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ৩১ আগস্ট আইসিইউ থেকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। পরে তাকে ওয়েলিংটন হাসপাতালে আনা হয়।

সরাসরি রাজনীতি না করেও এক বর্ণাঢ্য জীবনের মঞ্চে অবস্থান করেছিলেন আনিসুল হক। স্বপ্নজয়ের সিঁড়িতে ভর করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নগরবাসীর নজর কেড়েছিলেন তিনি। স্থবির হয়ে পড়া রাজধানীর গতিও ফিরিয়েছিলেন খানিক। রাজনৈতিক পরিচয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেও পেশীশক্তির রাজনীতিতে পা রাখেননি কখনই এই সফল ব্যবসায়ী। নষ্ট রাজনীতির কাদা গায়েও লাগননি তিনি। বরং রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করছেন, তাদের জন্যও ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তার বিদায় বেলায় কাঁদছেন অরাজনৈতিক আর রাজনৈতিক মঞ্চের মানুষরাও।

১৯৫২ সালে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন আনিসুল হক। শৈশব কেটেছে ফেনীর সোনাগাজীর নানাবাড়িতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। স্ত্রী রুবানা হক, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। শরিফুল হক ও রওশন আরা বেগম দম্পতির বড় সন্তান আনিসুল হক। তার ছোট ভাই আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক বর্তমানে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলের মেয়র নির্বাচনে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবেও তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে।

আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বড় ছেলে নাভিদুল হক দেশ এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওতে কর্মরত এবং আরেক মেয়ে তানিশা ফারিয়াম্যান হক মোহাম্মদী গ্রুপের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। মেয়র হওয়ার আগে ব্যবসায়ী হিসেবে তিনিই মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন।

তিনি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের তৈরি পোশাক খাত, জ্বালানি খাত, তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যম খাতের সঙ্গে জড়িত। পোশাকমালিকদের সংগঠন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি সার্কভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সংগঠন সার্ক চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত।

আনিসুল হক আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে পরিচিতি পান। তার উপস্থাপনায় বিটিভির ঈদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আনন্দমেলা, রাজনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠান মুখোমুখিসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচিত বিশেষ আলোচনায় আসেন।

মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ঢাকা মহানগরীর জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। যার সুফল পাচ্ছেন নগরবাসী। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে গিয়ে আনিসুল হক পরিবহনশ্রমিকদের তোপের মুখে পড়েন। পরে ওই সড়ক দখলমুক্ত করে তা সড়ক হিসেবে চালু করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।

সদ্যপ্রয়াত এই মেয়র গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিকশা এবং ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসসেবা চালু করেন। আনিসুল হকের উদ্যোগে গাবতলী সড়কটিও এখন দখলমুক্ত। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ইউলুপ করার উদ্যোগ নেন আনিসুল হক। মহাখালী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই।

মাত্র দুই বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নগরের রূপ বদলে দিতে পেরেছিলেন খানিকটা। তার জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ আর স্বপ্নের মধ্য দিয়েই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন নগরবাসীর মধ্যে।