- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

চট্টগ্রামে ডা. ফরিদা ইয়াসমিন সুমি’র তত্ত্বাবধানে নরমালে ৩ জমজ সন্তানের জন্ম!

নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ডা. ফরিদা ইয়াসমিন সুমির তত্ত্বাবধানে নরমালে ৩ জমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এক প্রসূতি। গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর এক বেসরকারি হাসপাতালে এ তিন জমজ সন্তান ভূমিষ্ট হন।

জানা যায়, চন্দনাইশ উপজেলার বেলতলা মো. নেওয়াজ খান ও তার সহধর্মীনির ঘর আলোকিত করে এ তিন জমজ সন্তান। তারা বর্তমানে নগরীর আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকায় বসবাস করেন।

এ ব্যাপারে শনিবার (১৬ মে) ডা. ফরিদা ইয়াসমিন সুমি তাঁর ফেসবুক আইডিতে বিষদ মন্তব্য করেছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-

ব্যক্তিগতভাবে আমি নরমাল ডেলিভারির পক্ষে। আমার সন্তান দুটিও নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে। স্বাভাবিক প্রসব করানোর জন্য সবসময় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকি। গতমাসের মাঝামাঝি সময়ে টেলিমেডিসিনে এক গর্ভবতী মায়ের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি এতদিন একজন অবস্টেট্রিসিয়ানের চেক-আপে ছিলেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ থাকায় অসহায় অবস্থায় পড়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একে তো এটি তাঁর প্রথম প্রেগন্যান্সি তার উপর একসাথে তিনটি বাচ্চা গর্ভে। ট্রিপলেট প্রেগন্যান্সি। ঘাবড়ে যাবারই কথা! কারণ মাল্টিপল প্রেগন্যান্সি সবসময়ই ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ (হাই রিস্ক) গর্ভ। এধরণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দেবার সম্ভাবনা অন্যান্য গর্ভের চাইতে অনেক গুণ বেশি। রোগী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের এসব জটিলতার ব্যাপারে কাউন্সেলিং করলাম। কথাবার্তায় বোঝা গেল, রোগীসহ বাড়ির সবাই ভীষণ টেন্সড। বাচ্চার সংখ্যা তিনটি হবার কারণে প্রচণ্ড নার্ভাস সবাই, বিশেষ করে রোগী দিনরাত কাঁদছে।

কাউন্সেলিং করার পর, অনেকটা পরিবর্তন এল। রোগীকে বললাম সৃষ্টিকর্তার পর তাঁর সুস্থতার দায়িত্ব আমি নিলাম, কিন্তু এক শর্তে, আজ থেকে অতিমাত্রায় টেনশন করা বাদ দিতে হবে।

ইনফার্টিলিটির (বন্ধ্যাত্ব) রোগীরা যখন কান্নাকাটি করেন, তাঁদেরকেও এভাবেই বলে থাকি, নেক্সট টাইম যদি হাসিমুখ না দেখি তাহলে আর ট্রিটমেন্ট করব না। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবার আগে চেষ্টা করি রোগীর মনের জোর বাড়াতে। এবং এতে সুফলও পাই।

‘ট্রিট দ্য পেশেন্ট, নট দ্য ডিজিজ’ এই মহান কথাটি সবসময় মাথায় রাখি। পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টে দক্ষতার কথা নিজে বলব না, সেটা অন্যেরা বলবে, তবে রোগীর সাথে ভালো ব্যবহার এবং তাঁদের সাথে একটা বন্ডিং তৈরির দক্ষতায় আমি সন্তুষ্ট, এটুকু বলতে পারি।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই চেম্বারে রুটিন পেশেন্ট দেখা বন্ধ রেখেছিলাম। শুধুমাত্র ডেলিভারি/ সিজারিয়ান সেকশন বা জরুরি রোগী এটেন্ড করছিলাম। রোগী চট্টগ্রামের হওয়াতে চেম্বারে আসতে বললাম। এই মাসের ২ তারিখ আসলেন। ২০/২১ বছর বয়সের মেয়ে, ৩২ সপ্তাহের গর্ভ, ব্লাড প্রেশার কিছুটা বেশি, চেহারাতে স্পষ্ট আতংকের ছাপ। এতদিন ম্যাসেজ বা ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। এবার সামনাসামনি পেয়ে রোগীকে মোটিভেট করা সহজ হল। বারবার সতর্ক করে দিলাম, যেকোনো সময় সে প্রিম্যাচ্যুর লেবারে (সময়ের আগে প্রসব) চলে যেতে পারে। সাহস দিলাম, ঈদের দিনেও যদি ব্যথা উঠে পাশে আছি। এবার চেম্বার থেকে বেরুনোর সময় তাঁকে অনেকটা নির্ভার মনে হল।

১৩ তারিখ বিকেলে হঠাৎ ফোন, কোমরে ব্যথা, সাথে হালকা রক্তপানি দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি হতে বললাম, হলো না করোনা আতংকে। ক্লিনিকের ডিউটি ডাক্তার এক্সামিনেশন করে জানালে বুঝলাম রোগী লেবারে যাচ্ছে। ডাক্তার আর মিডওয়াইফকে ফোনে ইনস্ট্রাকশন দিলাম করণীয় সম্পর্কে। ইফতার করে আস্তেধীরে গেলেই চলবে বুঝতে পারলাম।

ওরে বাবা! রোগী কী বসতে দেয়!
আমার এত সাধের কাউন্সিলিং এর ইফেক্ট বোধহয় হালকা হয়ে গেছে!
রোগী, রোগীর পরিবারের সবাই আমাকে ফোনের পর ফোনে অস্থির করে তুলল। নাকেমুখে ছুটতে হলো। গিয়ে দেখি, রোগীর মা-সহ লাইন ধরে সবাই কাঁদছে। কী ব্যাপার! আমার হাত ধরে মা কাকুতি মিনতি করল তাঁর মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তাড়াতাড়ি যেন সিজার করে বাচ্চা বের করে দিই। রোগী তো আমাকে দেখামাত্র লাফ দিয়ে উঠল, ম্যাডাম প্লিজ, সিজার করেন, আমি পারব না ব্যথা সহ্য করতে। বহুকষ্টে কুল ডাউন করলাম, এক্সামিন করলাম। কাছাকাছি সময়ে আল্ট্রাসাউন্ড করা ছিল না বলে বাচ্চাদের ওজন জানতে পারি নি। তবে ধারণা করলাম, এক থেকে দেড় কেজির ভেতরেই হতে পারে প্রত্যেকটি।

এক্সামিনেশন ফাইন্ডিংস খুবই ভালো। আশা করছি সুন্দর নরমাল ডেলিভারি হবে। প্রিম্যাচ্যুর ছোট ছোট বাচ্চার জন্য সিজার না করাই শ্রেয়। কিন্তু তা কি আর মানাতে পারি? আবার শুরু হলো কাউন্সেলিং। পুরুষ সদস্যদের তাড়াতাড়ি কনভিন্স করতে পারলেও মা আর মেয়েকে কনভিন্স করতে বেগ পেতে হলো খুব। অনেক ভাইয়ের একটিমাত্র বোন, মায়ের একমাত্র মেয়ে, খুব আদরের। ঠায় বসে রইলাম রোগীর পাশে। কিছুক্ষণ পরপর পরবর্তী স্টেপগুলো সম্পর্কে বলছিলাম আর সাহস দিচ্ছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে রোগী একদম শান্ত হয়ে গেল, চোখেমুখে ভরসার স্বস্তি দেখলাম এবং আমাকে সহযোগিতা করতে সম্মত হলো।

রাত ১২.২০ মিনিটে প্রথম বেবি (মেয়ে-১.২কেজি) তার ৫ মিনিট পর দ্বিতীয় বেবি (ছেলে-১.৫কেজি) এবং ১০ মিনিট পর তৃতীয় বেবি (মেয়ে-১ কেজি) ডেলিভারি হল। কোনো কম্পলিকেশন ছাড়া। বাচ্চাগুলো ছোট ছোট হলেও রিফ্লেক্স তুলনামূলক বেশ ভালোই ছিল। মায়ের হিমোগ্লোবিন আগে থেকে কম ছিল (০৯ গ্রাম/ডিএল) বলে ডেলিভারির পর এক ব্যাগ রক্ত দিলাম। আদারওয়াইজ এভরিথিং ওয়াজ ওকে। প্রিম্যাচ্যুর বেবি প্লাস লো বার্থ ওয়েট বলে বাচ্চাগুলো NICU তে রেফার করলাম।

১৬ মে খবর নিলাম, তিনটি বাচ্চাই এখনও পর্যন্ত ভালো আছে। আশা করছি প্রপার কেয়ার পেলে তিনজনই বেঁচে যাবে। বাচ্চাদের মায়ের মুখে বিস্তৃত হাসি। যেহেতু নরমাল ডেলিভারি, পরের দিন রিলিজ দিয়ে বাচ্চাদের কাছে থাকতে বললাম। সবাই দোয়া করবেন, ওরা যেন ভালো থাকে।