- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

করোনায় চাকরি হারিয়ে গ্রামের পথে নিম্নআয়ের মানুষ

নিউজ ডেক্স : করোনার কারণে নিম্নআয়ের মানুষ যতটা বিপদে আছে, তার চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। অনেকের চাকরি নেই, জমানো টাকাও শেষ। সরকারের করোনাকালীন বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচির তালিকায় দরিদ্র মানুষ নাম ওঠাতে পারলেও এই শ্রেণি কারো কাছে হাত পাততে পারছেন না। এ অবস্থায় আবারও গ্রামমুখী হচ্ছেন তারা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জরিপ মতে, নগরে বসবাসরতদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। জীবিকার তাগিদে থাকতে হয় ভাড়া বাসায়, থাকেন শিক্ষার্থীরাও। এমনিতেই বছর শেষে দিতে হয় বাড়তি ভাড়া। তার ওপর বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারা, শিক্ষার্থীদের টিউশনি, কোচিং ক্লাস বন্ধ থাকায় আয়ের উৎস থেমে গেছে।

ঈদুল আযহা’র বাকি আরও এক মাস। সাধারণত ঈদের আগে মানুষের শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়লেও করোনা এসব নগরবাসীকে এখনই বাধ্য করছে গ্রামে ফিরে যেতে। পিকআপ, ভ্যানগাড়ি বা ট্রাকে মালামাল নিয়ে পরিবারসহ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার চিত্র পুরো শহরজুড়ে। কেউবা বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে ছোট ফ্ল্যাট বা সাবলেটে ভাড়ায় থাকার চেষ্টা করছেন।

নগরের মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, ষোলশহর, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চকবাজার, নন্দনকানন, বাকলিয়া, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ইতোমধ্যে গ্রামে চলে গেছেন। যাওয়ার প্রস্তুতি আছে অনেকের।

ভাড়াটিয়া পরিষদের পক্ষ থেকে ভাড়াটিয়াদের বাসা ভাড়া, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিলসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি জানানো হলেও অধিকাংশ বাড়ির মালিক তা মানেননি। যদিও করোনার শুরুতে হাতেগোণা দুয়েকজন ভবন মালিক ভায়াটিয়াদের এ সুবিধা দিয়েছেন।

নগরের দুটি ওয়ার্ডে ইপসা পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে ১৮.৭ শতাংশ মানুষ এখন বেকার। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ দিনমজুর, ১২.৭ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক, ১১.৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ৩.৪ শতাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক।

জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও আউটসোর্সিং ভিত্তিতে নিয়োজিত কর্মচারীদের অনেকে কয়েকমাস ধরে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। কারও হয়েছে বাধ্যতামূলক ছুটি।

যাদের সন্তানরা পড়ালেখা করছে, তাদেরকে প্রতিমাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন, ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল দেওয়া ও খাওয়ার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দোকান থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে অনেক কর্মচারীকে। মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের টিউশনিও নেই।

চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকে কাজ করতেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাকলিয়ায় ছোট দুই কক্ষের ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে থাকতাম। প্রতিমাসে ভাড়া দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। তার সঙ্গে খাওয়ার খরচ, সন্তানদের পড়ালেখার খরচও আছে।

‘অফিস বন্ধ থাকায় বেতনও পাচ্ছি না নিয়মিত। এ অবস্থায় তাদের নিয়ে শহরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে গ্রামের বাড়ি মিরসরাই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

চকবাজারে মেসে থাকা কলেজ শিক্ষার্থী মইদুল হাসান বলেন, টিউশনি করে মেস ভাড়া ও পড়ালেখার খরচ চালাতাম। করোনা সব বন্ধ করে দিয়েছি। এই মাসে ধার করে ভাড়া দিয়েছি। আগামী মাস থেকে কক্সবাজারে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি।

একই সমস্যার কথা জানালেন ক্ষুদে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, তিনজন কর্মচারীকে ছুটি দিয়েছি অনিচ্ছাসত্ত্বেও। নিজেই চলতে পারি না, তাদের বেতন কিভাবে দেবো?

‘বিকাল ৪টার মধ্যে দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। ক্রেতাও কমে গেছে। করোনা কখন যাবে, তাও জানি না। এখন সাতকানিয়ায় গ্রামের বাড়িতেই যেতে হবে পরিবার নিয়ে। সামনের মাসে ভাড়া বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।’

শুধু এই ভাড়াটিয়ারাই যে সমস্যায় আছেন তা নয়, এভাবে ঘর ছেড়ে দেওয়ার হিড়িকে অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন অনেক বাড়ির মালিক-যাদের আয়ের উৎস ঘরভাড়া। নগরের প্রায় সব এলাকার অলি-গলিতে ভবনের সামনে ঝুলছে বাসা ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি।

নগরের মোহাম্মদপুর আবাসিক কল্যাণ সমিতি, চান্দগাঁও আবাসিক কল্যাণ সমিতি, নাসিরাবাদ আবাসিক কল্যাণ সমিতি, মৌসুমী আবাসিক কল্যাণ সমিতি, খুলশী আবাসিক কল্যাণ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এসব আবাসিক এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা প্রবাসী পরিবারের। গত তিন মাসে বাসা ছেড়ে গেছে পাঁচ শতাধিক পরিবার।

এছাড়া রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, পটিয়া, সাতকানিয়া, মিরসরাই, ফেনী, কুমিল্লার অনেকে থাকতেন, যারা বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ বাসা ভাড়া না দিয়েই গ্রামে চলে গেছেন।

মুরাদপুরের এক ভবন মালিক সামশুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, পাঁচতলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। ১০টি ফ্ল্যাটের ৯টিই ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। প্রতিমাসে ভাড়া আসতো প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে গৃহকরসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করতে হয়। আছে ভবন সংস্কার খরচও।

করোনার সময়ে ভাড়াটিয়ারা প্রতিমাসে ঘরভাড়া দিতে পারছেন না। এরইমধ্যে দুটি ফ্ল্যাট খালি হয়ে গেছে। আরও একজন ভাড়াটিয়া চলে যাবেন বলে জানিয়েছেন। এই অবস্থায় নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়াও কঠিন। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে-জানি না।

ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই কর্মজীবীরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এখন অনেকেই বেকার। এদের অধিকাংশই গ্রামে চলে গেছেন। সরকারের কাছে এপ্রিল, মে ও জুন মাসের ভাড়া মওকুফের নির্দেশনা প্রত্যাশা করছি। বাংলানিউজ