- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

করোনায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম, রোগীর চাপে হিমশিম অবস্থা

নিউজ ডেক্স : দিন দিন করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে চট্টগ্রামে। সংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যায় আগের দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পাল্লা দিয়ে রোগীর চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে গত বেশ কিছু দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা (কেবিন) সংখ্যা বাড়িয়েও চাপ সামালে হিমশিম অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতাল। শয্যা খালি না থাকায় প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী ফেরত দিতে হচ্ছে এসব হাসপাতালকে। তবে ঠাঁই না থাকলেও রোগী ফেরত দেয়ার সুযোগ নেই সরকারি হাসপাতালে। তাই বাধ্য হয়ে মেঝেতে রাখতে হচ্ছে রোগী। আইসিইউ শয্যা খালি-ই থাকছে না। একটি আইসিইউ শয্যা পেতে অপর কোন রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। অন্যথা আইসিইউ মিলছে না।

সংক্রমন ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টদের। নগরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই না থাকায় সঙ্কটময় পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে তৎপর হন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি এসব স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানও যাতে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসে, সেটাই চেয়েছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে পুরো হাসপাতাল সম্ভব না হলেও হাসপাতালের একটি অংশকে প্রয়োজনে কোভিড ডেডিকেটেড করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন তাঁরা। এ নিয়ে চিকিৎসা সুবিধা ও সক্ষমতা বাড়াতে চট্টগ্রামের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একাধিকবার সভা করেন প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান ও সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি দুটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনও করেন। এসময় চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে নির্দেশনা দেয়া হয় এসব হাসপাতালকে। কিন্তু দফায় দফায় নির্দেশনা এবং বৈঠকের পরও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সক্ষমতায় অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। কিংবা সক্ষমতা থাকলেও রোগীর আস্থা অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শুরু থেকেই করোনা রোগীর চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও কিছুটা সেবা পাচ্ছে করোনা রোগীরা। এর বাইরে অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে মোট ৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। এগুলো হল- মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ (ইউএসটিসি) হাসপাতাল, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই ৬টির মধ্যে মাত্র দুটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনা পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারছে। প্রশ্ন উঠেছে অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভূমিকা নিয়ে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সোমবারও (গতকাল) অনলাইনে সভা করেন চট্টগ্রামের প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর, সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সভায় অংশ নেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা এ সভায় যুক্ত ছিলেন।

সভার তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সোমবার কেবল বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এক হাজারের বেশি করোনা রোগী ভর্তি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে আরো প্রায় ৬’শ রোগী। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন ঠাঁই হচ্ছে না। আইসিইউ শয্যার সংকট। আমরা হয়তো আবারো ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই আশঙ্কাটা আমরা আগেই করেছিলাম। আশঙ্কা থেকেই বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে চিকিৎসায় সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডাক্তার, ইন্টার্ন ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আছে। তাই সক্ষমতা বা চিকিৎসা সুবিধা বাড়ালেই বেশ কিছু রোগী এসব প্রতিষ্ঠানেও চিকিৎসা সেবা পেত। সেদিক বিবেচনায় আমরা আগেই এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলাম। সক্ষমতা বাড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, হাতে গোনা দুই-একটি ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সুবিধা ও সক্ষমতায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। যারা সক্ষমতা থাকলেও রোগী পাচ্ছেন না বলছেন, তারা হয়তো রোগীদের সেই আস্থাটুকু অর্জন করতে পারেননি। স্বাস্থ্যের জন্য এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি আর আসবে কী না সংশয় প্রকাশ করে প্রশাসনের এই কর্মকর্তা বলেন, এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও যদি তারা ভূমিকা রাখতে না পারেন, এগিয়ে না আসেন; তাহলে আসবেন কখন?

সভা সূত্রে জানা গেছে, ৫০ শয্যা ও ৫টি আইসিইউ প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে ইউএসটিসি। কিন্তু তারা রোগী পাচ্ছেন না। মেরিন সিটি কিছু সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দিলেও অঙিজেন সংকটের কথা জানিয়েছে। সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। মাত্র ৩ জন রোগী ভর্তি। কিছুদিন আগে আইসিইউ সুবিধা যুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হলেও এখনো পর্যন্ত তারা তা করতে পারেনি। অন্যদিকে চন্দনাইশের বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ২০০ সিলিন্ডার থাকার কথা জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- এ হাসপাতালটি চাইলে দক্ষিনাঞ্চলের বেশ কিছু রোগীকে সেবা দিতে পারতো। সিলিন্ডারের সাহায্যে অন্তত কম অঙিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন এমন রোগীদের হলেও সেখানে সেবা দেয়া যায়। তবে প্রত্যাশিত সেবা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মিলছে না।

অবশ্য, অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসা সুবিধা ও সক্ষমতা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। গতকালের বৈঠকে তারা এমন আশ্বাস দেন বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব হাসপাতাল এখন রোগীতে ঠাসা মন্তব্য করে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, চমেক হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালের সব শয্যা রোগীতে ভরে গেছে। এখন মেঝেতে রোগী রাখতে হচ্ছে। জেনারেল হাসপাতালের দ্বিতীয় ইউনিট হিসেবে হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রোগী ভর্তি শুরু করতে হয়েছে। সেখানে আমরা ৬০ জন মতো রোগী ভর্তি রাখতে পারবো। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে ধাবমান, আমাদের আরো প্রস্তুতি দরকার। বেসরকারিগুলোতেও হিমশিম অবস্থা। এর জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও যাতে কোভিড চিকিৎসাটা নিশ্চিত করা যায়, আমরা সেটাই চেয়েছি। চট্টগ্রামে আমাদের ৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। তবে সব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সক্ষমতা সমান নয়। তবে আমরা চেয়েছি, সবকয়টি হাসপাতালই কোভিড চিকিৎসা শুরু করুক। কিছু রোগী হলেও এসব হাসপাতালে চিকিৎসা পাক। কিন্তু দুই-একটি ছাড়া অন্যরা প্রত্যাশিত অগ্রগতি দেখাতে পারেন নি।

এদিকে, সবকয়টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা গেলে শয্যা ও আইসিইউর জন্য হাহাকার কিছুটা হলেও কমতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, চমেক হাসপাতালের ৩০০ শয্যার করোনা ইউনিটে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩১০ জনের বেশি রোগী ভর্তি ছিল। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের দেড়শ শয্যায় ১৭০ জন রোগী ভর্তি ছিল। এ দুটি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা খালি থাকছে না অনেক দিন ধরে। বিআইটিআইডির ৫০ শয্যায় গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ৪৩ জন। এর বাইরে নগরীর উল্লেখযোগ্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সবকয়টিতেই কেবিন/শয্যার অতিরিক্ত রোগী। আইসিইউ শয্যা শূন্য নেই একটিও। – আজাদী প্রতিবেদন