- Lohagaranews24 - http://lohagaranews24.com -

এ যুগের ফখরুদ্দিন রাজী আমার উস্তাদ মাওলানা ফখরউদ্দীন হুজুর

IMG_20170125_122524_325
মঈনুদ্দীন চিশতী : জনাব ফখরউদ্দীন  হুজুরের বিষয় নিয়ে কি আর লিখবো?ঝিনুক কী সমুদ্র সেচতে পারবে?তাই সাহসে কুলায়না।তা ছাড়া খোদায়ী মদদ ছাড়া তো কিছুই করা সম্ভব নয়।আল্লামা ইকবাল বলেন “তেরে জমীর পেহ্‌ জব তক না হো নুজুলে কিতাব/গেড়া কুশা না হুগা কেহ্‌ রাজী সাহেবে কাশ্বাফ”।তোমার হৃদয়তন্ত্রীতে যতক্ষণ না খোদায়ী ইলহাম নাজিল না হয়, তুমি ফখরুদ্দিন রাজী বা মাহ্‌মুদ বাগদাদী হলেও কিছুই লিখতে পারবেনা।
আমার বুখারীর উস্তাদ মাওলানা ফখরউদ্দীন হুজুর ছিলেন ইনসানে কামেল অলি আল্লাহ।প্রকৃত অলি আউলিয়াদের যত গুণাবলী সবই তার মধ্যে বিরজিত ছিল।কিন্তু তাকে দেখে কেউ তা বুঝতে পারতো না।হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন ‘আউলিয়ায়ি তাহ্‌তা ক্বব্বায়ি আমার বন্ধুরা আমার চাদরে লুকানো থাকে লা ইয়ারিফুহুম ইল্লা মায়ি  আমাকে ছাড়া কেউ তাদের চিনতে পারেনা অর্থাৎ আমার রঙে রঙিন হলেই তাদের চেনা যাবে।তিনি ছিলেন লুকানো মানিক।দেশের সর্বোচ্চ সরকারী ইসলামী বিদ্যাপীঠ মাদ্রাসা ই আলিয়ার অধ্যাপক হয়েও তার চলা ফেরা পোষাক আশাক ছিল খুবই সাধারণ।সরকারী মাদ্রাসার শিক্ষক হলেও তিনি নানা অজুহাতে ক্লাস মিস করেছেন এমনটি মনে পড়েনা।তিনি প্রায়ই বলতেন ছাত্রদেরকে না পড়িয়ে বেতন নেয়া আমাদের জন্য বৈধ নয়।
ফখরউদ্দীন হুজুর আমার দৃষ্টিতে ব্যতিক্রমী একজন উস্তাদ।তার পড়ানোর ঢং ছিলো আলাদা।তামিরুল মিল্লাতের সাবেক প্রিন্সিপাল সাঈদ হুজুরের পর তাকেই দেখলাম একের ভিতর অনেক গুণে গুণান্বিত।হাদীস পড়ালেও তাফসীর নিয়ে কথা বলে মনে হতো তিনিই সাক্ষাৎ ফখরুদ্দীন রাজী।আর হাদীসের ক্ষেত্রে ইবনে হজর আসক্বালানী।ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আ্লোচনা করলে মনে হতো তিনিই যেন ইবনে খালদুন।এ কথাগুলো আমরা সরাসরি ছাত্র বলে বলছিনা।ক্বাওমী লাইনের আমার যে সব বন্ধুরা ঐ সময় লালবাগ বা বড়কাটরা মাদ্রাসায় পড়তেন।তাদের মুখে শোনা তাদের উস্তাদরা নাকি ফখরউদ্দীন হুজুরকে যথেষ্ট সমীহ্‌ করতেন।আর বলতেন সুযোগ পেলে তার দরসে বসবে। তার দরস শোনলে মনে হবে এ যেন ফখরউদ্দীন রাজী।
শৈশবে বড় কাটরা এবং লালবাগ পড়ার কারণে সেখানে আমার কিছু সহপাঠী ছিল।একদিন একজন এসে বলে তোদের এখানে নাকি ফখরউদ্দীন রাজী আছেন?আমাদের কাওমী উস্তাদরা তাকে খুবই মান্য করেন।এ কথা শুনে আমি ভাবি তাই তো তার পড়ানোর বৈশিষ্টই তো আলাদা।প্রতিটি হাদীসের সাথে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ নানা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রাবীদের পারস্পরিক সম্পর্ক এমন কী শব্দের প্রয়োগিক বৈশিষ্টও আলোচনা করতেন,ফলে অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে মৌমাছির মতো বসে থাকতো।
হযরত আলী রা সম্পর্কে একটি ঘটনাঃএকদিন হাদীস পড়াচ্ছেন এমন সময় হজরত আলী রা এর নাম এলে তিনি বলেন নবী স আলী সম্পর্কে বলেছেন ‘ওয়া আফাক্বু আলী’(তোমাদের মধ্য আলী সবচে’বড় ফকীহ্‌)। কীভাবে ফিক্বাহের জগতে আলীর মর্যাদা বেশী তা একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ আমাদের বুঝিয়ে দেন।
দুই ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ বাড়ী হতে বেড় হয়েছেন দূরে কোথায় কাজের সন্ধানে যাবেন।গৃহকত্রীরা তাদের প্রয়োজনীয় সামানের সাথে দুপুরের খাবারের জন্য কিছু রুটি ও পানি দিয়েছেন যাতে ক্ষুৎপিপাসায় খেতে পারেন।পথ চলতে চলতে দুপুর গড়ালে তারা এক ছায়াদার বৃক্ষতলে দস্তরখান পেতে বসেন খাবার খেতে।এমন সময় এক পথিক পাশ দিয়ে যাচ্ছেন।আরবপ্রথানুযায়ী তারা পথিককে খাবারে অংশগ্রহণের আহবান করলে তিনি তাদের সাথে দস্তরখানে বসেন খানা খেতে।তো সেখানে পুর্বোক্ত দুই ব্যক্তির যথাক্রমে ৫টি ও ৩টি মিলে মোট ৮টি রুটিকে প্রতিটি তিন টুকরা করে প্রত্যেকে ৮টুকরা করে সমভাবে খেয়ে যার যার গন্তব্যে যাবে এমন সময় আগুন্তক ব্যক্তি আল ইহ্‌সানু ইল্লাল ইহ্‌সান(দয়ার বদলা দয়া ভিন্ন আর কী)বলে তাদের ৮টি দিরহাম দিয়ে বলেন আপনারা তা বন্টন করে নেবেন।উনি চলে যাবার পর ৫রুটি অলা ব্যক্তি ৫টি দেরহাম রেখে অপর ব্যক্তিকে ৩টি দিয়ে বলেন আমার ৫টি রুটি ছিল তাই আমি ৫টি রেখে আপনাকে ৩টি দিলাম মনে হয় এটাই ন্যায়সঙ্গত।অপরজন বলেন তা কী করে হয় উনি তো আমাদের বন্টন করে নিতে বলেছেন উত্তম হয় সমানভাবে ভাগ করে নিলে।এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে উভয়েই এর ফায়সালার ভার হজরত আলী রা এর কাছে ন্যস্ত করলে তিনি বলেন, “তোমরা যে বন্টন করেছো তা উভয়ে মেনে নিলে ভালো যেহেতু তা তোমরা সেচ্ছায় করেছো।আর আমার ফায়সালা হলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হবে তখন কারো হয়তো মনপুত না ও হতে পারে”।তখন উভয়েই বলে আপনার রায় আমরা মেনে নেবো।এই কথা বলার সাথে সাথে আলী রা এক মুহূর্ত দেরী না করে বলেন যার যে ৫রুটির মালিক সে ৭ দেরহাম পাবে কারণ ১৫টুকরার ৮টি নিজে খেয়েছে আর ৭টি মেহ্‌মান খেয়েছে তাই সে ৭টির মূল্য পাবে আর ৩রুটির মালিক ১দেরহাম পাবে কারণ ৯টির ৮টি নিজে খেয়েছে আর মেহ্‌মান ১টি খেয়েছে তাই ১টির মূল্য পাবে। এই ঘটনা বলে হুজুর বলেন এমন একটি জটিল বিষয় কতো সহজে আলী রা মিটমাট করে দিলেন।আর বিচারের ফায়সালাটিও কতো যুক্তিসঙ্গত।আমাদের উস্তাদ ফখরউদ্দীন হুজুর এভাবে প্রাসঙ্গিক নানা আকর্ষনীয় ও শিক্ষামূলক ঘটনা তার দরসের ফাঁকে ফাঁকে বলে বিনিসুতার মালার মতো তার ছাত্রদের ক্লাসে ধরে রাখতেন।কিন্তু আমরা দূর্ভাগা তাকে যথাযথ মূল্যায়ণ করতে পারিনি। আল্লাহ তাকে জান্নাতে আলা মাক্বাম দান করুন।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গদীনশীন ও পরিচালক লালপূরী দরবার শরীফ।