নিউজ ডেক্স : বছরের পর বছর যে জমিতে শুধু লবণ চাষ করা হতো এখন সেখানে গড়ে উঠতে যাচ্ছে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা। সমুদ্রের উপকূলের সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে হতে যাচ্ছে ইকো ট্যুরিজম। আর সমুদ্রের গভীরতা কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক বন্দরের ‘আড়ালে’ হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর, নির্মিত হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। একই এলাকায় ভিড়ছে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসবাহী (এলএনজি) জাহাজ, পাইপলাইনে রয়েছে আরো এলএনজি ও এলপিজি কেন্দ্র। সেই কয়লা ও গ্যাস কেন্দ্র করে বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে নতুন শিল্প-কারখানায়।
মহেশখালী ও কুতুবতিয়াকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগের শুরু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ১২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরে। সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাঁচামালের জন্য কয়লার প্রয়োজন হবে, আর কয়লার জন্য বেশি ড্রাফটের বড় জাহাজ ভিড়তে হবে মহেশখালীতে। তাই এই জাহাজের জন্য তৈরি করা হচ্ছে বন্দরের চ্যানেল। এখন সেই চ্যানেলকে ব্যবহার করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায় নির্মিত হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এর পাশাপাশি দিনে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি এলএনজি প্ল্যান্ট বসেছে মহেশখালীতে। গত মঙ্গলবার এলএনজিবাহী জাহাজও ভিড়েছে মহেশখালীতে। এখন এ জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের পালা। পেট্রোবাংলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি এক্সিলারেটর এনার্জি লিমিটেড এই ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করবে। পাশাপাশি আসছে সামিটের আরো ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া পাইপ লাইনে রয়েছে কুতুবদিয়ায় দুই ভারতীয় কোম্পানি পেট্রোনেট ও রিলায়েন্সের ল্যান্ডবেইজড দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প। এই দুই প্রকল্প থেকে দৈনিক আসবে আরো ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

মহেশখালী-কুতুবদিয়া ঘিরে দেশের পাওয়ার হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে সম্প্রতি মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সংবাদকর্মীদের জানান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, মহেশখালী কুতুবদিয়া ঘিরে বিদ্যুৎ ও এলএনজির পাশাপাশি হতে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। আগামীতে এই এলাকা হবে দেশের পাওয়ার হাব।
মহেশখালী-কুতুবদিয়ার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় আর কী হতে যাচ্ছে তা জানতে কথা হয় স’ানীয় সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিকের সাথে। তিনি বলেন, ‘একসময় এখানকার জমিতে লবণ চাষ হতো। ভৌগোলিক অবস’ানগত কারণে এখন সেই জমিতে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার চোখ পড়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের পাশাপাশি মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় বেজার (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন অথরিটি) অধীনে ৭টি অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে এই এলাকায়।
এছাড়া পর্যটন কর্পোরেশনের অধীনে কুতুবদিয়ায় পৃথক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তবে মাতারবাড়িতে বন্দরের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বন্দরকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। অর্থাৎ দেশের আগামীর অর্থনীতির হাব হতে যাচ্ছে এই এলাকা।
একই বিষয়ে কথা হয় বেজার চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, ‘সত্যিই আমরা মহেশখালী ও কুতুবদিয়া ঘিরে বিশাল পরিকল্পনা নিয়েছি। আর তা টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই এলাকায় ৭টি অর্থনৈতিক জোন করার প্রস্তাবনা থাকলেও প্রাথমিকভাবে দুটি জোনের কাজ এগিয়ে চলছে।’
কোন দুটির কাজ এগিয়ে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি হলো এনার্জি জোন ও অপরটি ভারী শিল্প এলাকা। মাতারবাড়ির ধলঘাট এলাকায় এনার্জি জোন ও ভারী শিল্প এলাকা গড়ে তোলা হবে। এর পাশাপাশি সোনাদিয়া ঘিরে একটি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ চলছে।
এই এনার্জি জোনে কীভাবে বিনিয়োগ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগকারীদের ভূমি বরাদ্দ দিব। সেখানে তারা বিনিয়োগ করতে পারে। ইতিমধ্যে কয়েকটি কোম্পানিকে বরাদ্দও দেয়া হয়েছে।’
এদিকে বেজা সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে দেশের বিশিষ্ট শিল্পগ্রুপ টি কে গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসপিএল পেট্রোকেমিকেল কমপ্লেক্স লিমিটেডের (এসপিসিএল) সাথে ৪১০ একর জমির বরাদ্দ নিয়ে বেজার চুক্তি হয়েছে গত রোববার। এই জমিতে জেটি সুবিধাসহ পেট্রোকেমিকেল রিফাইনারি, পেট্রোলিয়াম পণ্য মজুদাগার, এলপিজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স’াপন করা হবে। এই প্ল্যান্ট স’াপন করা হলে কর্মসংস’ান হবে ১০ হাজার লোকের। এতে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে দক্ষিণ কুরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পগ্রুপ এসকে গ্যাস। প্রকল্পটি ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
মহেশখালী ও কুতুবদিয়া ঘিরে বিনিয়োগকে স্বাভাবিক আখ্যায়িত করে চিটাগাং চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন,‘বিশ্বের সব দেশে সাগরের উপকূল ব্যবহার করে বিনিয়োগ হয়ে থাকে। আমাদের দেশই শুধু ব্যতিক্রম ছিল। তবে এখন দেরিতে হলেও তা হতে যাচ্ছে। দেশের আগামীর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে টেকনাফ থেকে মিরসরাই পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা।’
মহেশখালী ও কুতুবদিয়াসহ পুরো এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বদলে যাবে জানিয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘যেভাবে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া এলাকায় বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বদলে যাবে। এই এলাকায় অনেক শিল্পায়ন হবে এবং মানুষের কর্মসংস’ানের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।’
উল্লেখ্য, ভোগৌলিক অবস’ানগত দিক দিয়ে মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। ৩৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মহেশখালী এবং ২১৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কুতুবদিয়া ঘিরে রয়েছে সাগর। মহেশখালী ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যে মহেশখালী চ্যানেল এবং কুতুবদিয়া ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যে রয়েছে কুতুবদিয়া চ্যানেল। বর্তমানে মহেশখালী চ্যানেলে ব্রিজ নির্মাণ করা হলেও কুতুবদিয়ায় যাতায়াতে চ্যানেল অতিক্রম করতে হয়।
সূত্র : দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ